করোনার শিখর পার হচ্ছে চট্টগ্রাম, সপ্তাহ পরেই পতনের পালা— আশার বাণী বিশেষজ্ঞদের মুখে
শেষ সময়ে মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে রোগীর অবস্থা
চট্টগ্রামজুড়ে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে যাওয়ার পর আক্রান্তদের উপসর্গ যেমন বদলে গেছে হঠাৎ, সেই সঙ্গে বদলে গেছে আক্রান্ত রোগীর ওপর করোনার প্রভাবও। চিকিৎসকরা বলছেন, অনেকটা ভালো ও স্থিতিশীল অবস্থায় থাকা রোগীকে দেখা যাচ্ছে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যাচ্ছে। ফলে হাসপাতালগুলোতে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। আর এর ফলে আইসিইউর ওপর থাকছে সার্বক্ষণিক চাপ।
অন্যদিকে করোনার আগের বিভিন্ন ধরনের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভিন্ন কিছু আচরণকে এই মুহূর্তে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা। তবে এর পাশাপাশি চিকিৎসকরা শোনাচ্ছেন আশার কথাও। তারা বলছেন, মহামারীর যে চরিত্র সে অনুযায়ী এর মধ্যেই করোনার ঢেউ তার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গেছে। এবার তারা সেই ঢেউয়ের পতনের পালা গুণছেন। তারা আভাস দিচ্ছেন, এই পতনটাও ঘটবে খুব দ্রুত। আগামী সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও সপ্তাহদুয়েকের মধ্যে কমে আসবে— এমনটাই অনুমান করছেন করোনা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
করোনার চলতি ঢেউয়ে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের সঙ্গে আগের রোগীদের কোনো পার্থক্য দেখছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডের ইনচার্জ ডা. রাজদ্বীপ বিশ্বাস চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গতবারেও হাসপাতালে শয্যা নিয়ে টানাটানির একটা সময় আমরা পার করেছি। তবে সেটার সাথে এবারের পার্থক্য হলো গতবার গুরুতর রোগীর সংখ্যা এতটা বেশি ছিল না, যতটা আমরা এবারে পাচ্ছি। এবারে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।’
এর কারণ হিসেবে ডা. রাজদ্বীপ বলেন, ‘দুটি কারণে এই সমস্যাটা এবার প্রকট মনে হচ্ছে আমাদের। একটি হল এবারে অপেক্ষাকৃত তরুণরাও সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাচ্ছে। যেটা আগেরবারগুলোতে সেভাবে দেখাই যায়নি। এছাড়া এবার রোগীদের অবস্থারও দ্রুত অবনতি হচ্ছে।’
স্থিতিশীল রোগীদের হঠাৎ করে সংকটাপন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ডাক্তার রাজদ্বীপ বলেন, ‘আগে একটা রোগী কিছু ধাপের মধ্য দিয়ে যেত। এবারে দেখা যাচ্ছে একদম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা একটা রোগীকে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আইসিইউতে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। একজন রোগী যার এক লিটার অক্সিজেনে সবই ঠিকঠাক, কিন্তু কয়েক ঘন্টা বা একদিনে হঠাৎ দেখা গেল তার অক্সিজেনের চাহিদা এতো পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে যে তাকে আইসিইউতে নেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকছে না। এই যে রোগীর দ্রুত সংকটাপন্ন হয়ে পড়া— এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা আগে ছিল না।’
তবে এখনও মৃত্যুর ক্ষেত্রে বৃদ্ধ ও আগে থেকে বিভিন্ন রোগে ভোগা ব্যক্তিরাই বেশি মারা যাচ্ছেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘যদিও তরুণদের অনেকে সংকটাপন্ন হচ্ছেন। তাদেরও আইসিইউ লাগছে। তবে মৃত্যুর হিসেবে দেখা যাচ্ছে যারা ৫০-উর্ধ্ব ও আগে থেকে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তাদের মৃত্যু হচ্ছে বেশি। আর তরুণ বা কম বয়স্কদের মধ্যে বেশি মারা যাচ্ছেন গর্ভবতী নারীরা।’
এসব কিছুর ক্ষেত্রে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন মন্তব্য করে চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা বিষয়ক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. অলক নন্দী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি সংক্রমণশীল আর রোগীদের ওপর এর প্রভাবও অনেকটা তীব্র। ফলে কিছু ক্ষেত্রে এটি বেশিই ক্ষতি করছে।’
তবে এর মধ্যেই করোনার চলতি ঢেউ তার সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গেছে জানিয়ে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা দেখছেন— এমন আশার কথা জানিয়ে ডা. অলক নন্দী বলেন, ‘মহামারীর একটা নিজস্ব ধরন আছে। আপনি একটু খেয়াল করে দেখুন ইতালি, আমেরিকা, ইন্ডিয়াসহ যেখানেই সংক্রমণ তীব্র হয়েছে সেখানেই এর তাণ্ডবের সময়টা মোটামুটি আড়াই থেকে তিন মাস স্থায়ী ছিল। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাশের দেশের দিকে তাকান তাদের যখন অবস্থা খুব খারাপ হয়, তখন তারাও যে অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে— ব্যাপারটা এমন না। তবে দুই তিন মাসের মধ্যে সেখানেও কমে গেছে। মহামারি একটা নিজস্ব রুলস মেনে চলে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা আগামী সপ্তাহ থেকে এখানেও সংক্রমণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। তবে এক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা এখন যেরকম, সেটা আরও কিছুদিন থাকবে। অর্থাৎ সংক্রমণ কমবে কিন্তু মৃত্যু কমবে না। সেটা কমতে আরও দুই তিন সপ্তাহ সময় লাগবে।’
সিপি