কনিষ্ঠ প্রভাষক এসে এক লাফেই চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের উপসচিব!

নিয়োগে অভাবনীয় অনিয়ম, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন একের পর এক

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে নিয়োগে পদে পদে চলছে অনিয়ম আর পদোন্নতিতেও মানা হচ্ছে না প্রবিধিমালা। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে প্রাধান্য না দিয়েই কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এমন এক নজিরবিহীন ঘটনায় দেখা গেছে, কনিষ্ঠ এক কলেজ প্রভাষক প্রেষণে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে গিয়ে এক লাফেই হয়ে গেছেন রীতিমতো উপ-সচিব। অথচ পদটির ন্যূনতম যোগ্যতা ‘সহকারী অধ্যাপক’। অতীতে এ পদে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সকলে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। এমন ঘটনা এই একটি নয়, ঘটেছে আরও বহু।

জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের একটি প্রজ্ঞাপনে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের উপসচিব পদে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো. বেলাল হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই নিয়োগ চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের কর্মচারী চাকরি প্রবিধিমালা (১৯৯৭) লঙ্ঘন করেই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের টপকে কনিষ্ঠ এই কর্মকর্তাকে করা হয় উপ-সচিব পদে পদায়ন। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের পদক্রম অনুযায়ী উপ-সচিব পদের অবস্থান সাত নম্বরে। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে উপ-পদমর্যাদার মোট পদের সংখ্যাও সাতটি। এ ক্রমানুসারে উপ-সচিব পদটি এই সাতটি পদের মধ্যে প্রথম। বোর্ডে কর্মরত উপ পর্যায়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা সহযোগী অধ্যাপক বা তদূর্ধ্ব হলেও সংস্থাপন শাখার বর্তমান উপ-সচিব মোহাম্মদ বেলাল হোসেন ২৯তম বিসিএসে প্রভাষক থেকে প্রেষণে নিয়োগ পেয়েছেন সরাসরি এই পদে। অথচ শিক্ষাবোর্ডের চাকরি প্রবিধিমালায় উপসচিব পদে পদায়নের জন্য যোগ্যতা হিসাবে ‘সহকারী অধ্যাপক’ হতেই হবে— এমন উল্লেখ করা আছে সুস্পষ্টভাবে।

উপসচিব পদে কনিষ্ঠ প্রভাষক বেলাল হোসেনের নিয়োগ চট্টগ্রামের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহলে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয়।
উপসচিব পদে কনিষ্ঠ প্রভাষক বেলাল হোসেনের নিয়োগ চট্টগ্রামের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহলে রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয়।

২৯তম বিসিএসের এই প্রভাষকের নিম্নপদস্থ সহকারী সচিব পদে রয়েছেন ২৪ বিসিএসের কর্মকর্তা এবং সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। অপর সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদার, তিনিও সহকারী অধ্যাপক। এছাড়া রয়েছেন সহকারী মূল্যায়ন কর্মকর্তা ড. শুক্লা রক্ষিত, যিনিও কিনা সহকারী অধ্যাপক হয়েই উল্লেখিত পদে পদায়ন হয়েছেন।

জানা গেছে, অতীতে এ পদে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সকলে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তবে শুধুমাত্র উপ-সচিব পদেই যে এমন হয়েছে তা নয়। শিক্ষাবোর্ডের অন্তত তিনটি শাখায় কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পদে পদায়ন করা হয়েছে কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই।

বিদ্যালয় শাখায় বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন করা হয়েছে বিপ্লব গাঙ্গুলীকে। তিনি ১৮তম বিসিএসের কর্মকর্তা। অথচ তার নিম্নপদস্থ উপ বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে পদায়ন করা হয়েছে আবুল বাসারকে— যিনি ১৬তম বিসিএসের কর্মকর্তা। অন্যদিকে শিক্ষাবোর্ডের উপ পরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) পদে পদায়ন করা হয়েছে মোহাম্মদ তাওয়ারিক আলমকে। তিনি ১৮তম বিসিএসের কর্মকর্তা। তার নিচের পদগুলোতে আছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা একেএম ইকবাল হোসেন এবং অডিট অফিসার প্রফেসর মৃণাল চন্দ্র নাথ। দুজনেই ১৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা।

জানা গেছে, মৃণাল চন্দ্র নাথ তাকে ‘প্রফেসর’ পদে পদায়ন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর কয়েক দফা আবেদনও করেছেন।

জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পদে কনিষ্ঠ কর্মকর্তার পদায়ন এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অধীনস্থ করায় শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চাপা ক্ষোভ। এসব ঘটনায় প্রভাব পড়েছে পুরো শিক্ষাবোর্ডের কর্মকাণ্ডে।

জানা যায়, প্রায় ছয়েক আগে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আদলে একটি সমিতি গঠন হয়। যার নাম দেওয়া হয় স্বাধীনতা বিসিএস শিক্ষা সংসদ। মূলত পোস্টিং সুবিধা পাওয়ার জন্যই এই সমিতি গঠন করা হয় বলে শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আর একজন মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এই স্বাধীনতা বিসিএস সংসদের প্রভাবেই চলছে প্রকাশ্য বিশৃঙ্খলা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের তফসিলে আছে এই পদে (উপ সচিব) পদায়ন হলে প্রার্থীকে যোগ্যতা হিসেবে সহকারী অধ্যাপক হতে হবে। এখন তো কোন কিছু বিবেচনা না করেই পদ দেওয়া হয়। যার ফলে সার্বিক কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। আর পদায়নে এসব বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু উনি (বেলাল হোসেন) আমাদের উপমন্ত্রীর কাছের মানুষ। বলতে গেলে ঝামেলা আছে।’

জানা গেছে, প্রভাব দেখিয়ে বোর্ডের উপ-সচিব মোহাম্মদ বেলাল হোসেন দাপ্তরিক নিয়মও মানতে চান না। এমনকি ছুটিছাটাও তিনি নিজের ইচ্ছেমতোই নেন।

শিক্ষাবোর্ডের সচিব ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল আলীম অসুস্থ থাকায় পদায়নের এই অস্বাভাবিক প্রবণতা নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। তিনি হোয়াটসঅ্যাপে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘গলার অবস্থা খারাপ। অসুস্থ, তাই রেস্ট নিচ্ছি।’

এদিকে ‘কর্মচারী চাকুরী প্রবিধিমালা ১৯৯৭’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বেলায়েত হোসেন তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খসড়া তো খসড়াই আছে। রাইট? খসড়া তো পাকা করা হয় নাই। আমি ঠিক আপনার এই পয়েন্ট অব কোয়্যারিতে এই মুহূর্তে কিছু জানাতে পারছি না।’

এরপর তিনি বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে আইনটা দেখতে হবে। এখন ভুল করলাম কিনা সেটা দেখে শিউর হয়ে জানাবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!