আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনেও আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা ২০১৮-তে ভোট দিয়েছেন নৌকা মার্কায়। আমরা তাই এই কক্সবাজারের উন্নয়ন করেছি। পর পর তিনবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছি। ২০০৯ সাল থেকে এই ২০২২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে বলেই এদেশে উন্নয়ন হচ্ছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।’
নৌকার আদলে গড়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেওয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা সমবেতদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন— ‘আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন?’
জনসভায় উপস্থিত মানুষ হাত তুলে তার কথায় সায় দেয়। তখন শেখ হাসিনা আবার বলেন, ‘আপনারা হাত তুলে আবার বলেন, দেবেন আপনারা?” উপস্থিত জনতা হাত তুলে তার কথায় সায় দিলে তিনি বলেন,আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জাতির জনকের কন্যা। যতক্ষণ ক্ষমতায় আছি আপনাদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমার। যাদের জন্য আমার মা-বাবা-ভাইয়েরা জীবন দিয়েছেন, আমি তাদের কল্যাণে কাজ করছি। আমি আমাদের আপনজন হারিয়েছি, আপনাদের মাঝেই আমি আমার আপনজন খুঁজে পেয়েছি। মানুষের ভাগ্য উন্নয়নই আমার লক্ষ্য।’
বুধবার (৭ ডিসেম্বর) বিকেলে কক্সবাজারের শহীদ শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী এ সব কথা বলেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভা পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কক্সবাজার পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান। জনসভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সিরাজুল মোস্তফা, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ।
সমাবেশে জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এটুকুই বলবো—রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নেই। আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা দোয়া করবেন। আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সব সময় দোয়া করি, আপনারা ভালো থাকেন, সুস্থ থাকুন, উন্নত জীবন পান, সেই কামনা করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। বাবা-মা-ভাই-আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে আমি রিক্ত, নিঃস্ব। কিন্তু যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য তারা প্রাণ দিয়ে গেছেন, তাদের জন্য কাজ করব। এদেশের মানুষের মাঝেই খুঁজে নেব প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনকে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যে গ্রেনেড যুদ্ধের মাঠে ব্যবহার করা হয় সে গ্রেনেড মারা হয়েছিল আমাদের ওপর। আমাদের আইভি রহমানসহ অনেকে মারা গেছে। আল্লাহর রহমতে আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম। ধ্বংস করা ছাড়া এরা (বিএনপি—জামায়াত) কিছু পারে না। ৭৫ এর পর এরা ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল। এরা কী দিয়েছে বাংলাদেশকে? জিয়া সরকার তো কিছুই দিতে পারেনি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জামায়াত—বিএনপি এই দেশের মানুষকে কী দিয়েছে? মানুষ খুন, মানি লন্ডারিং, বোমাবাজি এসব দিয়েছে তারা দেশকে। খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে দিয়েছে। তার কারাদণ্ড হয়েছে। তারেক রহমানেরও কারাদণ্ড হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের সমস্যা আমরা জানি, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। আমার বাবা যখন জেল থেকে বের হতেন তখন আমাদের নিয়ে কক্সবাজারে আসতেন। আমরা এখানে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এতই উন্নয়ন করেছি একসময় দেখবেন এই মহেশখালী সিঙ্গাপুরের চেয়ে সুন্দর হবে। কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে আরও দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দেবো। আমাদের সবসময়ের লক্ষ্য এই অঞ্চলের উন্নয়ন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাবা—মা সব হারিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। যে কারণে আমার বাবা সংগ্রাম করেছেন আমি সেই লক্ষ্যে আমি কাজ করে যাচ্ছি। বাংলার মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, বার বার ভোট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষকে ধন্যবাদ, আপনারা ২০১৮ সালে আমাদের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন। এই কক্সবাজারের উন্নয়ন জিয়া, এরশাদ ও খালেদা কেউই করেনি। আমরা যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছি তখন থেকে এই কক্সবাজারের উন্নয়ন করেছি। আজকেও ২৯টি প্রকল্প উদ্বোধন করেছি। এগুলো আপনাদের জন্য আমার উপহার।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশে কোন মানুষ ঠিকানাহীন থাকবে না। প্রতিটি এলাকায় ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের তথ্য পেলে নাম ঠিকানা দেবেন। তাদের জমিসহ ঘর দেয়া হবে।’
এদিকে শেখ হাসিনার জনসভা দুপুরে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জনসভাস্থলে আসতে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি প্রত্যেক উপজেলা থেকেও মিছিল নিয়ে আসেন নেতাকর্মীরা। তাদের মিছিল—স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সমুদ্র নগরীর সড়ক—মহাসড়ক।
বিকাল ৪ টার দিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মঞ্চে উপস্থিত হন।
প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে পৌঁছালে মাঠ উপস্থিত হাজার হাজার নেতাকর্মী মুহূর্ম করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উৎফুল্ল দেখা যায়। বিভিন্ন রংয়ের ক্যাপ, গেনি্জ পড়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। আওয়ামী লীগ প্রধানকে স্বাগত জানাতে গোটা শহরটিকে রঙিন সাজে সজ্জিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, সাধারণত মানুষ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজারে আসে। কিন্তু আজ জেলাটির বিভিন্ন এলাকার মানুষ আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে থেকে দেখতে ও তার বক্তৃতা শুনতে এই জনসভায় এসেছে।
কক্সবাজারে ২৯ প্রকল্প উদ্বোধন
এদিকে জনসভায় কক্সবাজারে ২৯টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও চারটি নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (৭ ডিসেম্বর) বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে কক্সবাজারের শহীদ শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় সুইচ টিপে তিনি এই প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন করেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২৯টি প্রকল্পে ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা চারটি প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫৭২ কোটি টাকা।
উদ্বোধন করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে—কক্সবাজার গণপূর্ত উদ্যান, বাহারছড়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঠ, কুতুবদিয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ভবন, পেকুয়া উপজেলা ভূমি অফিস ভবন, কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় ভবন, শেখ হাসিনা জোয়ারিয়ানালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন, আবদুল মাবুদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারতলা একাডেমিক ভবন, কক্সবাজার জেলার লিংক রোড—লাবনী মোড় সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, রামু-ফতেখাঁরকুল-মরিচ্যা জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প, টেকনাফ—শাহপরীর দ্বীপ জেলা মহাসড়কের হাড়িয়াখালী থেকে শাহপরীরদ্বীপ অংশ পুনর্নির্মাণ প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, বাঁকখালী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষ্কাশন সেচ ও ড্রেজিং প্রকল্প (১ম পর্যায়), শাহপরীর দ্বীপে সি ডাইক অংশে বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা কাজ, ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ডার সমূহের পুর্নবাসন প্রকল্প।
এছাড়া অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে— রামু কলঘর বাজার-রাজারকুল ইউপি সড়কে বাঁকখালী নদীর ওপর ৩৯৯ মিটার দীর্ঘ সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রদূত ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী সেতু, কক্সবাজার জেলায় নবনির্মিত ছয়টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ভবন, চারটি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন (রামু, টেকনাফ, মহেশখালী ও উখিয়া), কক্সবাজার পৌরসভার এয়ারপোর্ট রোড আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, শহীদ সরণি আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়াম সড়ক আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, নাজিরারটেক শুঁটকি মহাল সড়ক আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, টেকপাড়া সড়ক আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, সি বিচ রোড আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, মুক্তিযোদ্ধা সরণি আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প, সৈকত—সরণ আবাসিক এলাকা সড়ক আরসিসিকরণ ও অন্যান্য প্রকল্প।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য প্রস্তুত চার প্রকল্প হলো—বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প, কুতুবদিয়া উপজেলার ধুরুং জিসি মিরাখালী সড়কে ধুরুংঘাটে ১৫৩.২৫ মিটার জেটি ও আকবর বলি ঘাটে ১৫৩.২৫ মিটার জেটি নির্মাণ প্রকল্প, মহেশখালী উপজেলার মহেশখালী গোরকঘাটা ঘাটে জেটি নির্মাণ প্রকল্প এবং বাংলাদেশ—মিয়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা উন্নত করার জন্য উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় নাফ নদ বরাবর পোল্ডারসমূহের (৬৭/এ, ৬৭, ৬৭/বি এবং ৬৮) পুনর্বাসন প্রকল্প।
সিপি