ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পেলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারির সাবেক ছাত্রী সালমা সুলতানা

২০১২ সালে স্নাতক করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর পাঁচ বছর চট্টগ্রামের পটিয়ায় কাজ করেছেন ডেইরি ভেটেরিনারি ফাউন্ডেশনে। পরে ঢাকায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি প্রাণিচিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘মডেল লাইভস্টক ইনস্টিটিউট’। অনন্য কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সেই নারী ডা. সালমা সুলতানা এবার পাচ্ছেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের সম্মাননা। গত দুই বছর এই পুরস্কার পেয়েছিলেন যথাক্রমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ডা. রতন লাল এবং নেদারল্যান্ডসের সিমন গ্রুট।

বাংলাদেশ থেকে এর আগে ১৯৯৪ সালে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং ২০১৫ সালে ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।

মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ‘নরম্যান বোরলগ অ্যাওয়ার্ড ফর ফিল্ড রিসার্চ অ্যান্ড এপ্লিকেশন’ এর বিজয়ী হিসেবে বাংলাদেশের এই তরুণ ভেটেরিনারিয়ান ডা. সালমা সুলতানার নাম ঘোষণা করে।

মানুষের জন্য খাদ্য সহজলভ্য করতে এবং এর মান উন্নয়নে যারা কাজ করছেন, তাদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন প্রতিবছর এ পুরস্কার দেয়। ১৯৮৬ সালে নোবেলজয়ী নরম্যান বর্লুগ ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশন বলছে, বাংলাদেশে হাজারও ক্ষুদ্র খামারিকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে, তাদের গবাদিপশুর জন্য চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা পৌঁছে দিতে যে ব্যতিক্রমী মডেল সালমা গড়ে তুলেছেন, তার স্বীকৃতিতেই এবারের পুরস্কারের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পেলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারির সাবেক ছাত্রী সালমা সুলতানা 1

দেশে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৫ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সালমা শুরু করেন তার স্বপ্নের প্রকল্প ‘মডেল লাইভস্টক ইনস্টিটিউট ঢাকা’।

মাঠপর্যায়ে প্রাণিচিকিৎসায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে তার এ ইনস্টিটিউটে ১৪ মাস মেয়াদী ‘অ্যানিমেল হেলথ অ্যান্ড প্রোডাকশন’ ও ‘পোলট্রি ফার্মিং’ কোর্স করানো হয়। খামারিদের সচেতন করতে কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি প্রাণীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালও চালিয়ে আসছে মডেল লাইভস্টক।

ডা. সালমার এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যে কেবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে তাই নয়, বহু লোকের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়েছে— বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বারবারা স্টিনসন বলেন, ‘এই সাফল্য সহজে ধরা দেয়নি। পুরুষপ্রধান কর্মক্ষেত্রে সম্পদের যোগান যেখানে ছিল না বললেই চলে, সেখানে বহু বাধা পেরিয়ে এগোতে হয়েছে সুলতানাকে। কঠোর অধ্যবসায় আর উদ্ভাবনী ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি নিজের দেশের খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পেলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারির সাবেক ছাত্রী সালমা সুলতানা 2

২০১২ সালে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) বিষয়ে স্নাতক শেষ করে ভারতের তামিলনাড়ুতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন সালমা সুলতানা। এরপর দেশে নিজের পুরনো শিক্ষায়তনে ফিরে ২০১৪ সালে ফার্মাকোলজিতে মাস্টার্স করেন।

বাংলাদেশে প্রাণিচিকিৎসকদের ‘খুব একটা সম্মানের চোখে দেখা হয় না’ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতে হাতাশা ছিল সালমার মনে। স্নাতক শেষ করে পত্রিকায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে তিনি কমিউনিটি বেইজড ডেইরি ভেটেরিনারি ফাউন্ডেশনে ভেটেরিনারি অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।

সেখানে তিনি চাকরি করেছিলেন মাত্র পাঁচ মাস। চট্টগ্রামের পটিয়ায় ওই কাজ করতে করতেই তিনি মাঠ পর্যায়ে প্রাণিচিকিৎসকের সঙ্কট এবং গবাদিপশু নিয়ে খামারিদের অসহায়ত্ব দেখতে পান। তখনই সিদ্ধান্ত নেন, প্রাণিচিকিৎসার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগেই একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট খুলবেন তিনি।

২০১৪ সালে মাস্টার্স শেষ করে সালমা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ইনস্টিটিউটের অনুমোদনের জন্য। চাকরিজীবী বাবার জমানো টাকায় তার ‘মডেল লাইভস্টক ইনস্টিটিউটের’ যাত্রা শুরু হয়। ঢাকার ডেমরা এলাকায় কয়েকশ গবাদিপশুর খামার থাকায় ওই এলাকাতেই ইনস্টিটিউট খোলার সিদ্ধান্ত নেন সালমা। আমুলিয়া মডেল টাউনে জমি ইজারা নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান।

সালমার ইন্সটিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাঁচ শতাধিক তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তুলেছেন গবাদিপশু বা হাঁসমুরগির খামার। সেই সঙ্গে একশর বেশি সেবাকর্মী সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন।

ইন্সটিটিউটের কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় আরও কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে সালমা গড়ে তোলেন মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সড ফাউন্ডেশন। এর সদস্যরা নিয়মিত বিভিন্ন খামার পরিদর্শন করেন এবং খামারিদের পরামর্শ সেবা দেন।

ডা. সালমা সুলতানা বলেন, “এই স্বপ্নকে সত্যি করতে আমি রাত দিন খেটেছি। আমি কখনোই মাঝখানে আটকে থাকতে চাইনি, নিজেকে শুধু বলেছি, ‘হাল ছেড়ো না’।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!