ওমানে এমপি সনি ১৮ ঘন্টা পর মুচলেকাতেই মুক্ত— এবার স্বীকার করলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও
আরও ১৭ জনকে ছেড়েছে রয়্যাল পুলিশ
ওমানে নিজের মেয়েসহ প্রায় ১৮ ঘন্টা আটক থাকার পর চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে শেষ পর্যন্ত ওমান রয়্যাল পুলিশের কাস্টডি থেকে ‘মুচলেকা’ দিয়ে মুক্ত করা হয় বাংলাদেশ দূতাবাসের হস্তক্ষেপে। এ ঘটনায় মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) ধাপে ধাপে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরীন মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগ পর্যন্ত সাংসদ এদিকে ‘আটকের বিষয়টি সত্য নয়’ দাবি করে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কাছে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি দাবি করে আসছিলেন, তিনি গ্রেপ্তার হননি। এতে গ্রেপ্তারের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের কন্যা এবং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
বৃহস্পতিবার সাংসদ সনির সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরীন বলেন, ঘটনাটা জানার পর ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাস কার্যক্রম চালিয়ে সংসদ সদস্যকে মুক্ত করে।
তিনি জানান, দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবারের (১ আগস্ট) ঘটনায় মোট ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে ১৭ জনের মধ্যে ওমানে যারা প্রবাসী বাংলাদেশি আছে, তারা মুক্তি পেয়েছেন। পরে, আপনি যেটা বললেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব থেকে যে কয়জন ছিলেন, তাদেরকেও আজকে মুক্ত করা হয়। এখন কেউ পুলিশ কাস্টডিতে নেই।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরীন বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্থানীয় আইনকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার এবং মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি প্রত্যাশা থাকবে যে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দ ও উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা যখন বিদেশ সফর করেন, তখন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তাদের সভা করার ক্ষেত্রে প্রবাসীরা স্থানীয় আইন যথাযথভাবে মেনে চলবেন। যাতে এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়।
পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, ওমানে কোনো ধরনের সভা করার ক্ষেত্রে নিষেধ আছে এবং যারা ওখানে সভা করেছিলেন, তারা ওমান সরকারের অনুমতি নেননি। এ ছাড়া সংখ্যায়ও অনেক বেশি ছিলেন। এটি হোটেলে করা হয়েছিল। এ জন্য পুলিশ তৎপরতা চালায়।
এ ধরনের পরিস্থিতি প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য যেমন বিব্রতকর, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের জন্যও বিব্রতকর বলে উল্লেখ করেন সেহেলি সাবরীন।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়ানো হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরীন বলেন, ‘আমি দূতাবাস থেকে যত দূর জানতে পেরেছি যে সংসদ সদস্যকে পুলিশ কাস্টডি থেকে আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা গিয়ে পুলিশকে বুঝিয়ে তাকে মুক্ত করে। দূতাবাসের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে সবকিছুর একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে। দূতাবাস যখন হস্তক্ষেপ করেছে, তখন দূতাবাসের একটি মুচলেকা…হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই তো পুলিশ কাস্টডি থেকে মুক্ত করা হয়েছে।’
যা ঘটেছিল
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে চট্টগ্রামের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে প্রায় ১৮ ঘন্টা আটকে রাখে দেশটির রয়্যাল পুলিশ।মঙ্গলবার (১ আগস্ট) ওমান সময় রাত ১০টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা) ওমানের রাজধানী মাসকাটের বাণিজ্যিক কেন্দ্র রুয়িতে ওই ঘটনা ঘটে। ওই সময় ওমান রয়্যাল পুলিশের ১৫-২০টি গাড়ির বহর পুরো হোটেল ঘিরে ফেলে। ওমান সময় রাত ১১টার দিকে সেখান থেকে সাংসদ সনি ছাড়াও অন্তত ১৮ জনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে নিজ কন্যাসহ সাংসদ সনিকে ১৮ ঘন্টা আটকে রাখার পর বাংলাদেশ দূতাবাসের মধ্যস্থতায় মুচলেকা নিয়ে বুধবার (২ আগস্ট) বেলা ১১টায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, সোমবার (৩১ জুলাই) রাতে সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এক ব্যক্তিগত সফরে ওমানের রাজধানী মাসকাটে পৌঁছান। মাসকাট বিমানবন্দরে এ সময় তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নাজমুল ইসলামের পক্ষে দ্বিতীয় সচিব আছাদুল হকসহ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ওই সময় তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও।
ওমানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনি মূলত ব্যক্তিগত সফরে ওমানে এসেছেন। তিনি আসার পর সংবর্ধনা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে কয়েকটি সংগঠন এ নিয়ে উদ্যোগী হয়। কিন্তু এমন আয়োজনের খবর পেয়ে ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস তাতে অসম্মতি জানায়। যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা ছিল না, এজন্য দূতাবাস সাংসদ সনিকে প্রটোকল দিতেও অস্বীকৃতি জানায়।
ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই নেতা দাবি করেন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ আয়োজনে ওমান কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ ধরনের কোনো আয়োজন না করার জন্য সতর্ক করে দেয়। তারা সব আয়োজন শুধুমাত্র ঘরোয়াভাবে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য অনুরোধ জানান সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, ওমানের রাজধানী মাসকাটের বাণিজ্যিক কেন্দ্র রুয়িতে অবস্থিত ‘হাফা হাউস’ নামের একটি হোটেলে সাংসদ খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। আয়োজক হিসেবে ব্যানারে ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি’র কথা উল্লেখ করা হলেও এতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, চট্টগ্রাম সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১ আগস্ট) ওমান সময় রাত ১০টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা) সংবর্ধনা সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর ওমান রয়্যাল পুলিশের অন্তত ২০টি গাড়ির বহর রাজধানী মাসকাটের বাণিজ্যিক কেন্দ্র রুয়িতে অবস্থিত ‘হাফা হাউস’ নামের হোটেলটি ঘিরে ফেলে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে এ সময় সেখানে উপস্থিত অনেকে আশেপাশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও সাংসদ সনি ছাড়াও অন্তত ১৮ জনকে আটক করে ওমান পুলিশ। এদের প্রায় সকলেই সংবর্ধনা সভার আয়োজক। আটকদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন ওমান আওয়ামী লীগের নেতা সবুজ সিকদার, নোমান, তৌহিদ, মান্নান প্রমুখ। তাদের বিরুদ্ধে ওমান সরকারের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক সভা আয়োজনের অভিযোগ আনা হয় বলে ওই সূত্র জানায়।
সিপি