এস আলমে মোটাতাজা বিএনপি নেতা, নৌবাহিনীর সোহায়েলের সঙ্গে ছিল বড় বাণিজ্য

দুদকের মামলার জালে ধরা স্ত্রী

চট্টগ্রামের গন্ডামারায় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। এর নির্মাণকাজের শুরুতে বাধা দেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদ লেয়াকত আলী। বসতভিটা রক্ষা কমিটির ব্যানারে পরিচালিত এক আন্দোলনে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল লেয়াকতের অনুসারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে প্রাণ হারান চারজন। আহত হয় কয়েকশত মানুষ।

২০২১ সালে বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে সাইফুল আলম মাসুদের পাশে বিএনপি নেতা লিয়াকত।
২০২১ সালে বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে সাইফুল আলম মাসুদের পাশে বিএনপি নেতা লিয়াকত।

এদিকে হতাহতের ঘটনার পরপরই লেয়াকতকে বাগিয়ে নেয় শিল্পগ্রুপ এস আলম। সাইফুল আলম মাসুদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সময় কোস্টগার্ডের দায়িত্বে থাকা নৌবাহিনী কর্মকর্তা পরে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান হওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন। তিনিও তখন এস আলমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর সোহায়েলকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। গুম-খুনের জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২১ আগস্ট তাকে গ্রেপ্তার হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে এস আলম গ্রুপকে ‘প্রটেকশন’ দেওয়ার কাজে সোহায়েলের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানও।

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে লেয়াকতের ঘনিষ্ঠতা ছিল বরাবরই।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে লেয়াকতের ঘনিষ্ঠতা ছিল বরাবরই।

জানা গেছে, এস আলমকে ঘিরে লেয়াকতের সঙ্গে সোহায়েলের ছিল কমিশনের বড় বাণিজ্য। দুজনই এ থেকে বিপুল লাভবান হন। দুজনেরই ছিল এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য। নৌবাহিনী কর্মকর্তা এম সোহায়েল এ সময় শত কোটি টাকা বাগিয়ে নেন এস আলম থেকে।

বাঁশখালীতে এস আলমের মালিকানাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ বিভিন্ন সময়ে ১৫ জন নিহত এবং অন্তত চার শতাধিক লোক আহত হয়েছে।
বাঁশখালীতে এস আলমের মালিকানাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ বিভিন্ন সময়ে ১৫ জন নিহত এবং অন্তত চার শতাধিক লোক আহত হয়েছে।

তবে এস আলমের সংস্পর্শে এসে বিএনপি নেতা লেয়াকত রাতারাতি হয়ে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টকে ঘিরে ভূমি বেচাকেনা, প্রকল্পে শ্রমিকসহ মালামাল সরবরাহ এবং স্ক্র্যাপ ব্যবসাসহ প্রায় সবই লেয়াকতের নিয়ন্ত্রণে। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিএনপি নেতা লেয়াকতের কাছে কোনঠাসা ছিলেন।

এস আলমে মোটাতাজা

জানা গেছে, ২০১৬ সালের পর এস আলমের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার পর লেয়াকতকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য গন্ডামারার গরিব মানুষের জায়গাজমি নামমাত্র মূল্যে এস আলমের হাতে তুলে দিয়ে নিজে বনে যান শত কোটি টাকার মালিক। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সফেক্ট্রার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে এস আলমের ভরাট কাজ থেকে ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন লেয়াকত। এই টাকা থেকে লেয়াকত নিজে ও তার স্ত্রীর নামে অন্তত ১০০ বিঘা জায়গা কেনেন।

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্রে লেয়াকত ও তার বাহিনীর সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১০ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালির ঠিকাদারের কাজে বাধা দেন লেয়াকত। মূলত বালির ঠিকাদারি নিয়েই এই ছিল বিরোধ। অন্যদিকে লেয়াকতের বাহিনীও গুলি ও ইটপাটকেল ছোঁড়ে। এতে বেশ কয়েকজন ছয়জন শ্রমিক ছাড়াও বাঁশখালী থানার ওসি তদন্ত সুমন চন্দ্র বণিক, এসআই মো. মাসুদ ও লিটন চাকমা, এএসআই নজরুল ইসলাম ও আব্দুল খালেক, পুলিশ সদস্য মফিজুল আলম ও ঠিকাদার মো. সায়মন আহত হন।

এ ঘটনায় লেয়াকতের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হয়। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি লেয়াকত আলীকে চট্টগ্রাম জেলা ডিবি পুলিশ চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।

সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নয়াপল্টন এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে লেয়াকতকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার দুদিন পর ৭ আগস্ট তিনি কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

কারাগার থেকে জামিনে এসেই লেয়াকত আবার হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে ফের একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য লেয়াকতের নেতৃত্বে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ওপর হামলা ছাড়াও মালামাল লুটের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। গত ২৭ আগস্টও লেয়াকতের বাহিনী এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। তারা এ সময় প্রতিষ্ঠানটির মালামাল দখলের চেষ্টা চালায়।

দুবার বহিষ্কার বিএনপি থেকে

লেয়াকত আলী ২০০৩ সালে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে পর পর দুইবার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করায় লেয়াকতকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে তখনও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সালাহউদ্দিনের সঙ্গে লেয়াকতের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওই নেতার মাধ্যমে দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি বানিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কয়েকজনের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। তবে পদ না পেয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা কৃষক দলের সাবেক সদস্য সচিব আবদুর রশিদ দৌলতি ১৫ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে লেয়াকত আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় লেয়াকত আলী কারাগারেও যান। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর বিএনপি থেকে লেয়াকতের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

ঘাড়ে ২৭ মামলা

বিএনপি নেতা লেয়াকতের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি, পুলিশের ওপর হামলা, দস্যুতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ২৭টি মামলা রয়েছে। তবে মামলা থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে ভয় পান পুলিশ কর্মকর্তারা। লেয়াকতের বাসার আশেপাশে সবসময় আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লোকজন পাহারা দেন।

জানা গেছে, বাঁশখালী থানা, বাঁশখালী আদালত, আনোয়ারা থানা, বাকলিয়া থানাসহ বিভিন্ন থানায় ১৯৯৪ সাল থেকে পৃথক পৃথক ভাবে নয়জনকে হত্যা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক উৎপাদনকারী আইন, নাশকতার ঘটনা, পুলিশের ওপর হামলা, চেক জালিয়াতিসহ ২৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ১৯৯৪ সালে গন্ডামারার আবু তাহের ও ১৯৯৯ সালে গন্ডামারার নুরুল কবিরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গন্ডামারার মর্তুজা আলী, মো. আংকুর. জাকের আহম্মদ ও জাকের হোসেনসহ ৪ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী মোহাম্মদ আলীকেও প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৪ সালে ১৮৭৮ সনের অস্ত্র আইনের ১৯(এ) মামলা নং ১৭, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক উৎপাদনকারী আইন ( সংশোধিত ২০০২) এর ৩/৪ এর ধারায় মামলা, ২০২৩ সালে পুলিশের ওপর হামলা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঠিকাদারের কাজে বাধাদানের ঘটনায় তিন মামলা।

দুদকের মামলায় স্ত্রীসহ লেয়াকত

মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) লেয়াকত আলী ও তার স্ত্রী জেসমিন আকতারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ অর্থ আয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের দুজনের বিরুদ্ধে।

দুদকের মামলায় লেয়াকতের স্ত্রী জেসমিন আকতারের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৬ লাখ ২৬ হাজার ২৬২ টাকার সম্পদ অর্জনের মিথ্যা তথ্য দেওয়া ছাড়াও ২ কোটি ৮৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৬২ টাকার সম্পদ অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জন করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদকের মামলার বিবরণে জানা গেছে, আসামি জেসমিন আকতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করা হয়। ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণীর দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে তার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন। তার

এর আগে জেসমিন তার সম্পদ বিবরণীতে ২ কোটি ৩৯ লাখ ৭৫ হাজার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য ঘোষণা দেন। দুদক এই সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার নামে ১৬টি দলিলমূলে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৭৯ টাকা স্থাবর সম্পদের খোঁজ পায়। সেখানে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ৮৭৯ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ এনেছে দুদক।

অন্যদিকে জেসমিন আকতার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে কোনো অস্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দিলেও দুদকের অনুসন্ধানে তার নামে ১১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের একটি প্রাইভেটকার (রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-০৩৬২), বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম শাখা থেকে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক বাঁশখালী শাখার হিসাবে জমা ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৬ টাকা, ফার্স্ট সিকিউিরিটি ইসলামী ব্যাংক পাঁচলাইশ শাখায় জমা ১ লাখ ৪ হাজার ৬১৫ টাকা, পাঁচলাইশ শাখায় ভিন্ন অ্যাকাউন্টে ৩৭ হাজার ২৯৩ টাকা, বাঁশখালী শাখায় ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮ টাকার খোঁজ মিলেছে। সবমিলিয়ে তার অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে ৮০ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮৩ টাকা।

দুদকের অনুসন্ধানে জেসমিন আকতারের নামে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ১ হাজার ২৬২ টাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। অর্জিত সম্পদের চেয়ে জ্ঞাত আয়ের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে ২ কোটি ৮৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৬২ টাকা।

দুদক জানিয়েছে, চেয়ারম্যান থাকাকালে লেয়াকত আলী অসৎ উপায়ে তার অর্জিত অর্থ দিয়ে তার স্ত্রীর নামে সম্পদ অর্জনের সহযোগিতা করায় দন্ডবিধি ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭ (১) ধারাসহ দন্ডবিধি ১০৯ ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm