প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একের পর এক ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহ। আগের বছরের অকৃতকার্য হওয়া পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নেই নেওয়া হয়েছে নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা। এবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা না ঘটলেও ঘটেছে ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহের মতো গুরুতর বিভ্রাট। ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এসএসসির প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের বাংলা প্রথম ও বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় ঘটেছে তেমনই ‘নিছক ভুলের’ মতো ঘটনা। বাংলা প্রথম পত্র বিষয়ের দুটি (এমসিকিউ ও সৃজনশীল) অংশে এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রে এমন ঘটনা ঘটে।
ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণের ঘটনায় ইতিমধ্যে ৫ কেন্দ্র সচিব এবং চার শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী শৃঙ্খলা কমিটির সভায় গাফলতির দায়ে শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে।
যেসব কেন্দ্রে বিলি করা হয় ভুল প্রশ্নপত্র
অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১৮ সালের সিলেবাসে প্রণীত প্রশ্নপত্র দিয়েই নেওয়া হয়েছে নিয়মিতদের পরীক্ষা। পার্বত্য বান্দরবানের লামা উপজেলার লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, খাগড়াছড়ির রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মানিকছড়ির রানী নিহারদেবী উচ্চ বিদ্যালয়, চিন্তাহরি উচ্চ বিদ্যালয়, কক্সবাজারের ঈদগাঁহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মিরসরাইয়ের দুটি কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহের এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি কেন্দ্রের এক কিংবা দুটি কক্ষের পরীক্ষার্থীরা এ ঘটনার শিকার হয়েছে।
আবার কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করা হয় নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র। আবার একই কেন্দ্রে ঘটেছে উল্টো ঘটনাও। জল ঘোলা করার মতো কোনো কোনো কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় পর পুনরায় সঠিক প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণের তথ্যও মিলেছে। এবার সাতটি কেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটে। একইভাবে ভুল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা গ্রহণের ঘটনা ঘটে গত বছরের (২০১৯ সালের) এসএসসির প্রথম পরীক্ষাতেও। গতবার ৮টি পরীক্ষা কেন্দ্রে, এবার ৭টি পরীক্ষা কেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটল।
এদিকে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অন্তত ৫০ জন নিয়মিত পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে অনিয়মিতদের জন্য ২০১৮ সালের সিলেবাসে প্রণীত প্রশ্নপত্রে। খাগড়াছড়ির রামগড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভুলে প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ৯৪ জন পরীক্ষার্থীর। নিয়মিত এসব পরীক্ষার্থীকে অনিয়মিতদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়।
তবে ২০১৮ সালের (অনিয়মিত) দুজন পরীক্ষার্থীকে প্রশ্ন দিতে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটেছে বলে দায় স্বীকার করে নেন কেন্দ্র সচিব আব্দুল কাদের। ঈদগাঁহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২২ জন পরীক্ষার্থীও একই ভুলের শিকার হন। কেন্দ্রটির কিছু সংখ্যক নিয়মিত পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করা হয় অনিয়মিতদের (২০১৮ সালের) প্রশ্নপত্র। আর কিছু সংখ্যক অনিয়মিত পরীক্ষার্থীকে সরবরাহ করা হয় নিয়মিতদের প্রশ্নপত্র। আবার ভুল প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা শুরুর ১৫-২০ মিনিট পর পুনরায় সঠিক প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণের তথ্যও পাওয়া গেছে এই কেন্দ্রে। এর ফলে সময় নিয়েও বেকায়দায় পড়ে শিক্ষার্থীরা। মিরসরাইয়েও একই রকম ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় দিনের বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায়।
বোর্ড সূত্রে জানা যায়, নিয়মিত ও অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ধরনের প্রশ্নপত্র। আবার অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দুই ভাগ রয়েছে। এক অংশ পুরাতন সিলেবাসে পরীক্ষা দেবে আবার আরেক অংশ নতুন সিলেবাসে পরীক্ষা দেবে। ১৫-১৬ ও ১৬-১৭ সেশনের জন্য পুরাতন সিলেবাসের প্রশ্নপত্র। আবার ১৭-১৮ ও ১৮-১৯ সেশনের আরেক সিলেবাসের প্রশ্নপত্র। এর মধ্যে ১৭-১৮ সেশন হলো অনিয়মিত পরীক্ষার্থী। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে দুই ধরনের প্রশ্নপত্র থাকায় গোলমাল পাকিয়ে ফেলেন কেন্দ্রসচিবরা। প্রশ্নপত্রের জগাখিচুড়ি বানিয়ে অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের নতুন সিলেবাসের প্রশ্ন আবার নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের পুরাতন সিলেবাসের প্রশ্ন সরবরাহ করে। আর এতেই ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দেয় পরীক্ষার্থীরা।
তবে শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, যে সকল কেন্দ্রে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়বে না। টানা দুই বছর এমন ভুলের দায়ভার কার? ভুল প্রশ্ন সরবরাহ কার গাফিলতিতে— এমন প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র দুই সিলেবাসে হয়। পুরাতন সিলেবাসে একটা প্রশ্ন হয়। নতুন সিলেবাস আরেকটা প্রশ্ন হয়। অনিয়মিতদের মধ্যে দুটি গ্রুপ। নতুন সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে আবার অনিয়মিতদের একটা অংশ দেবে। এ কারণে কেন্দ্রসচিব ভুল করে ফেলেছেন। গাফিলতি মূলত কেন্দ্র সচিবের।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রসচিবকে নির্দেশনা দিয়েছি অনিয়মিতদের আলাদা বসাবেন। তারা বসিয়েছে। কিন্তু অনিয়মিতদের দুটি গ্রুপ হওয়ায় কেন্দ্রসচিবের গাফিলতির ভুলে এমন ঘটনা ঘটে। সাধারণত অনিয়মিত পরীক্ষার্থী কম থাকে।’
এক প্রশ্নের জবাবে নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেন, ‘এবছর ঢাকা থেকে একটা দিকনির্দেশনা এসেছে। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর বিন্যাসের সময় আলাদা করে ফেলা হবে অর্থাৎ রোল নাম্বারের সিরিয়ালটা আলাদা হবে যাতে কেন্দ্র সচিব দেখামাত্রই বুঝতে পারেন এই পরীক্ষার্থী অনিয়মিত। আশা করি আমরা এই এইচএসসি থেকে নির্দেশনা অনুসারে কাজ করতে পারবো।’
একই ভুলের বারবার পুনরাবৃত্তি। গাফিলতির শাস্তি কেমন— এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘হ্যাঁ, এটা চরম গাফিলতি। এরপরও কেন্দ্রসচিবদের এমন ভুল মানার নয়। পরবর্তী শৃঙ্খলা কমিটির সভায় দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ সাবেক অধ্যক্ষ ডা. আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিয়মিত ও অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্রের প্যাকেট আলাদা থাকে। সেক্ষেত্রে ওপরে লেভেলের (সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ) কোনো গাফিলতি থাকে না। তখন কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব প্যাকেট দেখে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা। এখানে গাফিলতি হচ্ছে কেন্দ্র সচিবের। কেন্দ্র সচিবের আন্তরিকতার অভাব, দায়িত্বশীলতার অভাব, উদাসীনতা এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এমন ভুলটা হয়। কেন্দ্র সচিবের এই দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’
ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার্থীদের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই সমস্যা হবে। যখন সে (পরীক্ষার্থী) দেখবে তার পড়ার ভেতরের প্রশ্ন পরীক্ষায় আসেনি, তখনই তো সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবে। সাধারণত বাচ্চারা পাবলিক পরীক্ষায় এমনিতেই ভেতর থেকে একটু নার্ভাস হয়ে যায়। সে জায়গায় সে যখন দেখে প্রশ্নটা তার সিলেবাসের না, তখন প্রথম ধাক্কাতেই সে নার্ভাস হয়ে যায়। পরে কেন্দ্রসচিব হয়তো বলবেন পরীক্ষা দিয়ে দাও সমস্যা নাই। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে যাবে। এ কারণে তার পরীক্ষাতে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা গেলেও আমাদের শিক্ষকদের অবহেলাজনিত গাফিলতি অচিরেই বন্ধ করতে হবে। না হয় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে পড়বে।’
এ প্রসঙ্গে নাসরিন চৌধুরী নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘পাবলিক পরীক্ষার মতন পরীক্ষায় উনারা ভুল করেন তাহলে দেখেন কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন তারা। ভুল করবে তারা আর মাশুল গুণবে আমাদের বাচ্চারা।’
আরেক অভিভাবক নাজমুল হক বলেন, ‘শিক্ষাবোর্ডের কাছে আবেদন আপনারা ব্যবস্থা নিন। বাচ্চাদের জীবন নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলবেন না দয়া করে।’
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের ক্ষতির শিকার হবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘না কোনো অসুবিধা হবে না। মূলত অনিয়মিতদের মধ্যে দুই রকম থাকায় ভুলটা হয়েছে। তারপরও আমাদের কাছে শিক্ষার্থীদের স্বার্থই সবার আগে। কোনো শিক্ষার্থী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেভাবেই ব্যবস্থা নেব।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবে পরীক্ষা শেষ হলো। এখন তো খাতা (উত্তরপত্র) বিতরণ প্রক্রিয়া চলছে। সামনের শৃঙ্খলা কমিটির সভায় দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সিপি