বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম কলকাতায় খুন হওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে খুনিরা কেন বেছে নিল কলকাতাকে? তবে কি কলকাতায় খুনিদের সেইফ ল্যান্ড? নাকি খুনিদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়ার ট্রানজিট রোড। সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বহুদিনের পুরোনো ঈর্ষা। এখন কলকাতায় সাংসদ খুন হাওয়ার বিষয়টি আরও নতুন করে ভাবাচ্ছে দুই দেশকে।
কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনস নামের বিলাসবহুল যে অ্যাপার্টমেন্টে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে, সেই বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার হোতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন মিয়ার নাম বলেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল। তিনি গলাকাটা পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তার বিরুদ্ধে খুলনা, যশোর ওই এলাকাগুলোতে হত্যাসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে।
আখতারুজ্জামানের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে, এলাকায় তিনি শাহীন মিয়া নামে পরিচিত। তার ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার।
সংসদ সদস্য আনারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “পরিকল্পনা মোতাবেক তারা ২৫ এপ্রিল কলকাতার সেই বাসাটি ভাড়া করে। চুক্তি হয় তারা ৩০ এপ্রিল সেই বাসায় উঠবেন। সেই মোতাবেক আখতারুজ্জামান শাহীন, আমানউল্লাহ ও শিলাস্তি ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে ফ্লাইটে কোলকাতা গিয়ে সেই বাসায় ওঠেন।বাংলাদেশের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়নি, ধরা পড়ার ভয়ে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা আবার চলে আসবে, সে মোতাবেক তারা কাজ করেছে।”
হানি ট্র্যাপ ছিল কি না, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে ঘটনাটি কি না কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এখানে আছে কি না; সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জিহাদ পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন যে আখতারুজ্জামানের নির্দেশে তিনিসহ ৪ জন এমপিকে তার নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। তারপর তারা ফ্ল্যাটের মধ্যেই পুরো শরীর থেকে সমস্ত মাংস আলাদা করে এবং মাংসের কিমা করে সমস্ত কিছু পলিথিনের প্যাকে রেখে দেয়। পাশাপাশি হাড়গুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে প্যাক করে। তারপর সেই প্যাকেটগুলো ফ্ল্যাট থেকে বের করে, বিভিন্ন ধরনের পরিবহন ব্যবহার করে এবং কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় ফেলে দেয়।
খুনিরা কেন বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতাকে বেছে নিলেন তা হয়তো তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে ঘটনার নির্যাস বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় খুনিরা ভেবেছিল যে তারা কলকাতায় খুন করলে সহজে ধরা পড়বে না। দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির দাবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে ট্যারর ল্যান্ড ও জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন। যার কারণে অপরাধীরা সহজে তাদের অপরাধ কাজ সংগঠিত করতে পারছে। কলকাতাকে বেছে নেওয়ার অন্য একটি কারণ হলো ভারতের লোকসভা নির্বাচন।প্রশাসনের কর্মকর্তারা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এই সুযোগে তারা হত্যাকাণ্ড চালাবে। খুনিদের পরিকল্পনা মাফিক আনারের মোবাইল থেকে বিভিন্ন বার্তা প্রেরণ ও বিহারে দুইবার মোবাইল ফোনটি সচল করা এসব ছিল তাদের পরিকল্পনার মাস্টার স্টোক। যার দরুন আখতারুজ্জামান ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট যোগে সহজে নেপাল হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া এসব ছিল তাদের নিখুঁত পরিকল্পনার অংশ।
দেশের বাইরে খুন হওয়ায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে আসলেই কি পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক নিরাপত্তা দুর্বল নাকি কোন চক্র তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে? দুই দেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব সোহার্দ্য ও সহযোগিতার সম্পর্ক কী ফাটল ধরবে? নাকি দুই দেশ এসব খুনিদের জন্য জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে? সময় হয়তো এসব উত্তর যথাযথভাবে দিয়ে দিবে। তাই এখনই উচিত এসব না ভেবে ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন করে সঠিক বিচার করা।
লেখক: গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক