‘এত মার্ডার কেন হচ্ছে’—বিস্ফোরক মন্তব্য বিচারক ইসমাইলের

রোহিঙ্গা ক্যাম্প ক্রিমিনাল তৈরির কারখানা, মাদক ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে

‘কক্সবাজারে এত মার্ডার কেন হচ্ছে জানেন? রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে কেবল ১৫০ মার্ডার শুধু তাদের ভেতরে হয়েছে। মানে ১৫০ মার্ডার মামলা, কিন্তু মার্ডার হয়েছে আরও বেশি, সংখ্যাটা ৫০০ থেকে ৭০০ হয়ে যাবে। যেমন সিক্স মার্ডার হয়েছে, ছয়জনের জন্য মাত্র একটা মামলা হয়েছে। আমি যদি কক্সবাজারে ইয়াবা বন্ধ করতে পারি, তাহলে ১০ হাজার লোক বেকার হয়ে যাবে। এখানে একশ্রেণির আইনজীবী ও মুহুরিও জড়িত আছে। পুরো বাংলাদেশে মাদক যাচ্ছে কক্সবাজার থেকে।’

শনিবার (১২ আগস্ট) কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলকে বিদায় সংবর্ধনা দেয় নাগরিক ফোরাম। অনুষ্ঠানে বিচারক এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আমার এইখানে এখনও ২৭৮টি মিস কেইস আছে। ৮০ শতাংশ মাদক মামলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লোকজনদের নামে, এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হলে ক্রিমিনাল তৈরির কারখানা। এসব আবার আমাদের একশ্রেণির মানুষের জন্য সোনার খনি। জামিন দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের তথাকথিত একশ্রেণির আইনজীবীর কোনো কাজ থাকবে না।’

জামানত রেখে জামিন দেওয়ার প্রসঙ্গে এই বিচারক বলেন, ‘১৮৯৮ সনে ব্রিটিশদের করা সিআরপিসি আমি পড়েছি। সিআরপিসির ৫১৩ ধারায় বলা হয়েছে আপনি জামানত রেখে জামিন দিতে পারবেন। কেন দিচ্ছি, কারণ ওদের ৪-৫ বছর হয়ে গেছে, কাস্টডিতে আর কত দিন রাখবো? আমাদের তো এত বেশি জজ নাই বা এত বেশি ট্রায়ালের সুবিধা আমরা দিতে পারছি না। ৩-৪ বছর ধরে তারা ১-২ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ে কাস্টডিতে আছে। ২০১৮ সালে পর না হয় সর্বোচ্চ সাজাটা মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে, কিন্তু ১৯৯০ সালের আইনেও তো এর সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে ১৫ বছর। কক্সবাজারে ১০ হাজারেরও অধিক ইয়াবা মামলা, ৩০টার মতো বড় বড় চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা যেগুলোর সাজা হয়েছে, যেমন আলো হত্যা মামলা, মেজর সিনহা হত্যা মামলা।’

মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিষয়ে মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘যেটার কথা আপনারা বারবার বলছেন মেজর সিনহা হত্যা মামলা, এর পেছনেও ইয়াবা। ওর অপরাধ হলো সে এখানে কিছু ডকুমেন্টারি করছে, যারা মারা পড়েছে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত লোকগুলো মেজর সাহেবকে কিছু তথ্য দিয়েছে। ওইগুলোর ভিডিও করেছে, ডকুমেন্টারি করেছে। ওরা ভয় পেয়েছে যে, এরা অন্যত্র গিয়ে ওগুলো প্রকাশ করে দেবে বা অথরিটির কাছে দিবে, তখন এর একটা বিপদ হয়ে যাবে।’

সিনহা হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী বিচারক বলেন, ‘আমি ট্রায়াল করতে গিয়ে দেখেছি ফরিদুল মোস্তফা নামে একজনের ছয়টা মামলা। ওই সময় এই ঘটনা ঘটেনি (সিনহা হত্যা) সম্ভবত সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চ মাসে আমি তাকে পাঁচটা মামলায় জামিন দিয়েছি, তবে একটা মামলায় জামিন দিইনি। তখন আমার আইনজীবীরা বলেছেন, স্যার এটাতে জামিন দিয়েন না, দিলে তারে ক্রসফায়ার দিয়ে দেওয়া হবে। অন্তত তার জানটা বাঁচুক, জেলখানায় থাকলে তার জীবনটা থাকবে। আপনারা বখতিয়ার মেম্বারকে তো দেখেছেন। একটা লুঙ্গি পরা লোককে দুটা থানার ওসি ধরে, ভিডিওতে দেখা গেছে। পরে তার লাশটা পাওয়া গেছে। অথচ বখতিয়ার মেম্বারের বিরুদ্ধে কোনো মাদকের মামলা ছিল না।’

মাদক নিয়ে ধরা পড়া আসামিদের জামানতের মাধ্যমে জামিন প্রথা চালুর মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করা বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল অবসরে যাচ্ছেন। চাকরি জীবন শেষ হওয়ায় আগামী ১৪ আগস্ট থেকে তিনি অবসরে যাবেন। কক্সবাজার জেলায় ৩ বছর ৬ মাস দায়িত্ব পালনের পর চাকরির বয়সসীমা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বুধবার (৯ আগস্ট) তাকে কক্সবাজার থেকে বদলি করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।

কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনকালে মাদক নিয়ে সরাসরি ধরা আসামিদের জামিন দিতে জামানত প্রথা চালু করেন তিনি। তার এই উদ্যোগের ফলে গত কয়েক বছরে আসামিদের জামিনের জামানত বাবদ প্রায় ১৮ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। কক্সবাজারে দায়িত্বকালীন সময়ে তিনি প্রায় ৩০ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করেন।

মোহাম্মদ ইসমাইল ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের ১৭তম জেলা ও দায়রা জজ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কক্সবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ও চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তিকারী বিচারক। এর আগে তিনি বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

কক্সবাজারের সদ্য বিদায়ী সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল চট্টগ্রামের ভূজপুর উপজেলার বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্সসহ এমএলএম সম্পন্ন করেন। তিনি ১০ম বিসিএস (জুডিসিয়াল) প্রাপ্ত হন।

সংগঠনের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আইনজীবী, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন।

জেএন/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm