এতো অজগর কেন নেমে আসছে চট্টগ্রামের লোকালয়ে?

প্রাণীবিদরা বলছেন, অজগর লোকালয়ের কাছাকাছি থাকা প্রজাতির সাপ নয়। কিন্তু গত এক মাসে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে লোকালয়ে বেরিয়ে আসা অন্তত ছয়টি বিরাটাকায় অজগর ধরা পড়েছে। সবগুলোকেই উদ্ধার করা হয়েছে কৃষক বা খামারীদের পেতে রাখা জালে আটকে পড়া অবস্থায় এবং পরে সেগুলোকে উম্মুক্ত বনভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মাত্রই গত রোববার (১৫ আগস্ট) দুপুরে হাটহাজারীর চিকনদণ্ডী উত্তর ফতেয়াবাদ গ্রাম থেকে ১২ ফুট লম্বা ও ১১ কেজি ওজনের একটি অজগর উদ্ধার করা হল। মাদ্রাসা শিক্ষক মুহাম্মদ খালিদের বাড়ির ছাদে অজগরটি দেখার পর খবর পেয়ে বনবিভাগের লোকজন এসে সেটি উদ্ধার করে স্থানীয় পাহাড়ি এলাকায় ছেড়ে দেয়।

গত ৮ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বৈলছড়ি ইউনিয়নের অভ্যারখীল এলাকার একটি বাড়ি থেকে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সোনালি অজগর সাপ উদ্ধার করলো বন বিভাগ। সাপটির ওজন ১০ কেজি। খবর পেয়ে বনবিভাগের লোকজন এসে সাপটিকে উদ্ধার করে বাঁশখালী ইকোপার্কে ছেড়ে দেয়।

গত ১০ জুলাই হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর জামতলা এলাকা কৃষিজমিতে একটি অজগর নেমে এলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের ছাত্ররা সাড়ে ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ কেজি ওজনের অজগরটি উদ্ধার করে চবির গহীন বনে অবমুক্ত করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও প্রায়ই পাহাড় থেকে নেমে আসা অজগরের দেখা মেলে।

গত এক মাসে চট্টগ্রামসহ কুমিল্লা, নরিসংদী ও চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় লোকালয়ে বেরিয়ে এসে অন্তত ছয়টি অজগর ধরা পড়েছে। এদের দৈর্ঘ্য ছিল আট ফুট থেকে ১২ ফুটের মধ্যে। সবগুলোকেই অবশ্যই জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন অভয়ারণ্য ও গহীন বনে উম্মুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে অজগর সাপগুলো লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে কেন?

অজগর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সাপ। বাংলাপিডিয়া অজগর সম্পর্কে বলছে, এটি সার্পেন্টস বর্গের অন্তর্গত নির্বিষ সাপ। অন্য যেকোন সাপের তুলনায় অজগর দীর্ঘ হয়। এর আঁশ মসৃণ। অজগরের দাঁত অত্যন্ত শক্তিশালী, কিন্তু কোনো বিষদাঁত নেই। গ্রীবা স্পষ্ট, মস্তক প্রশস্ত এবং তুন্ড দীর্ঘ। অজগরের চোয়ালের পেশীগুলো খুবই নমনীয়। শিকারকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয় অজগর সাপ। অজগর বড় প্রাণী খায়, মানে ইঁদুর থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত গিলে খেতে পারে। মৃত প্রাণী খায় না অজগর। আক্রান্ত না হলে অজগর মানুষকে আঘাত করে না।

লোকালয়ে ধরা পড়া অধিকাংশ অজগর পাওয়া গেছে হাঁস-মুরগির খামারে, না হয় মাছের ঘের বা পুকুরে। তবে অজগরের পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে ইঁদুর, খরগোশ, ছাগল, ভেড়া, শিয়াল এবং হরিণের মত প্রাণী। খাওয়ার আগে অজগর তার শিকার পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে।

বেরিয়ে আসছে অজগর

গত ৩০ জুন চট্টগ্রামের পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের একটি গরুর খামার থেকে স্থানীয় গ্রামবাসীরা উদ্ধার করে ১২ ফুট লম্বা এক অজগর সাপ। পরে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ পটিয়া রেঞ্জের শ্রীমাই বন বিটের গভীর জঙ্গলে ওই সাপটিকে ছেড়ে দেয়।

গত ৬ জুন মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ অলিনগর আবাসন এলাকার একটি ঘরের খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি অজগর সাপ। পরে করেরহাট বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সাপটি গভীর জঙ্গলে অবমুক্ত করা হয়।

গত ২৯ মে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর লিঙ্ক রোডের পাশ থেকে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি অজগর সাপ উদ্ধার করা হয়। পরে অজগরটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়।

দেশে কি অজগরের সংখ্যা বেড়েছে?

প্রাণীবিদ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অজগরের নয়টি প্রজাতি আছে। তবে, বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরণের অজগর সাপ বেশি দেখা যায়। একটি বার্মিজ পাইথন, এটি স্থানীয়ভাবে ময়াল নামেও পরিচিত। আরেকটি রেটিকুলেটেড পাইথন, এই দ্বিতীয় ধরনটিকে গোলবাহার বা জালি অজগরও বলা হয়।

লোকালয়ে অজগরের বেরিয়ে আসার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শোনা গেছে। এ কারণে বাংলাদেশে অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা এমন একটি ধারণা রয়েছে অনেকের মনে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপতত্ত্ব বিষয়ে পড়ান এবং গবেষণা করেন অধ্যাপক ফরিদ আহসান। তিনি বলছিলেন, অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে দেশে, তবে এ সংক্রান্ত পরিষ্কার কোন হিসাব প্রাণীবিদদের কাছে নেই।

তবে অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক আহসান। তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে এটা বলতে পারি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অজগরের প্রাকৃতিক প্রজনন বেড়েছে।’

২০২১ সালের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অজগরের ছোট ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা যায় এখানে প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘দেশের অনেক জায়গাতেই এমনটা ঘটেছে। এর অর্থ হচ্ছে, তারা আশ্রয় পাচ্ছে বলেই প্রাকৃতিক প্রজনন ঘটতে পারছে।’

অধ্যাপক আহসান বলেছেন, ‘এর বাইরে আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। আগে সাপ দেখতে পেলেই মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলত, কিন্তু এখন তা করে না। আক্রান্ত না হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ সেটা বন বিভাগের কাছে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হস্তান্তর করে দেয়। অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।’

তবে অজগরের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক প্রাণীবিদের।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান বলছেন, ‘সংখ্যা বাড়েনি অজগরের, কারণ তাদের আবাস বা হ্যাবিটাটের সংখ্যা বা পরিমাণ তো বাড়েনি। বরং তারা লোকালয়ে আসছে এবং ধরা পড়ছে বলে সেটা মানুষ জানছে। তাতে করে মনে হচ্ছে যে সংখ্যা হয়ত বেড়েছে।’

লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে কেন?

অজগর সাধারণত উপদ্রবহীন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে, যে কারণে তারা লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলের গভীরে থাকে। বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, অধিকাংশ অজগর কিছুটা বৃক্ষবাসী। তবে নদী, হাওর কিংবা ঝিলের কাছেও এদের দেখা যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহসান বলছেন, যে কোন বন্যপ্রাণীর আবাস ঝুঁকির মুখে থাকলে এবং খাবারের সংকট হলে তারা লোকালয়ে বেরিয়ে আসে। অজগরের ক্ষেত্রেও আবাস সংকোচনের ফলে তাদের খাবার সংকট হচ্ছে। ফলে তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে খাবারের খোঁজে আসছে।

‘এ পরিক্রমায় অনেক সময়ই তারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ে আর বের হতে পারে না’— বলছেন তিনি।

এছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে পাহাড় বা ঘন জঙ্গল আছে, সেসব জায়গায় এপ্রিল-জুন এ সময়ে পাহাড়ে অনেক সময় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অধ্যাপক আহসান বলছেন, ওই সময় আগুনের কারণে বা প্রচন্ড গরমে সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় অজগর বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান মনে করেন, বর্ষাকালে নিচু এলাকা ডুবে যাওয়ায় বা স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ার কারণে তুলনামূলক উঁচু জায়গায় চলে আসে অজগর। আবার বন্যায় ভেসেও অনেক সময় তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে আসে। এছাড়া অজগরের প্রজননের সময় শুরু হয় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে। ফলে এই সময়ে তাদের লোকালয়ে বা প্রকাশ্য স্থানে কম দেখা যায়।

বিবিসি অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!