ইসলামের দৃষ্টিতে এতিমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার উপায়। এতিম একটি শব্দ যা শুনলে হৃদয়ে ধাক্কা না দিয়ে পারে না। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে দুঃখবোধ জাগ্রত হয়। পৃথিবীতে এমন কোন মানব সন্তান নেই যে এই শব্দটাকে ভয় করে না। কোন পিতা মাতা চান না যে মহান রব তার ছেলে মেয়েকে অসহায় রেখে তাকে ডেকে নিয়ে যান। এতিম অনাথ হওয়ার চেয়ে বড় বেদনার বড় দুঃখের আর কিছু নাই। এই সময় বড় অসহায়ত্বের সময় বড় নি:সঙ্গতার সময়। এই সময়ের চেয়ে বড় অসহায়ত্বের সময় আর মানুষের জীবনে নেই। কারো মা বাবা মারা গেলে দুরের মানুষও ভাবতে থাকে এই এতিম বাচ্চাটির কী হবে ? কে তাকে লালন পালন করবে? পিতা মাতা থাকলে একটি শিশু ভয় আর উদ্বেগহীন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। পিতা মাতা তাকে সব সময় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। তার অসুখ বিসুখ তার প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে পিতা মাতা তার সুযোগ সুবিধা সব কিছু দেখেন। মহান আল্লাহ কোরআনুল কারীমের ২২ খানা আয়াতে ২২ বার ইয়াতিম শব্দটি এক বচন বা বহুবচন অবস্থায় বর্ণনা করেছেন। এই সকল আয়াতে কারীমায় এতিমদের মর্যাদা এতিমদদের অবস্থা খোদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এতিম অবস্থার বর্ণনা এতিমদের অধিকার এতিমদের অধিকার হরণের ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন।
ইসলামি সমাজ এমন একটি সমাজ যে সমাজে পরস্পর সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন সম্প্রীতি বর্তমান থাকে। এ জন্য এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ আচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন (হে নবী) আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। (সুরা দুহা : আয়াত-৮) এতিমদের প্রতি যে সম্পদ ব্যয় করবে তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হওয়া উচিত। ইরশাদ হয়েছে তারা আহারের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না। (সুরা দাহর : আয়াত-৮, ৯)। সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব [তিনি তর্জনী ও মধ্য আঙুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন]।
এতিমের সাহায্যকারী মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন বিধবা এতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। হাদিস শরিফে এসেছে যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। অন্যত্র নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন মুসলিমদের ঐ বাড়িই সর্বোত্তম যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঐ বাড়ি যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অতঃপর তিনি তার অঙুলির মাধ্যমে বলেন আমি ও এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিশুকালে এতিম ছিলেন। জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারান। তিনি সারাটি জীবন সমাজের এতিম অসহায়দের জন্য কাজ করেছেন। আল্লাহ বলেন তারা তোমাকে এতিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও তাদের ইসলাহ তথা সুব্যবস্থা (পুনর্বাসন) করা উত্তম। (সুরা বাকারা : আয়াত-২২০) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন পিতৃহীনদেরকে পরীক্ষা করতে থাকো যে পর্যন্ত না তারা বিবাহযোগ্য হয়। অতঃপর তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের জ্ঞান দেখলে তাদের সম্পদ তাদেরকে ফিরিয়ে দাও। তারা বড় হয়ে যাবে বলে অপচয় করে ও তাড়াতাড়ি করে তা ভক্ষণ করো না। যে অভাবমুক্ত সে যেন যা অবৈধ তা থেকে নিবৃত্ত থাকে এবং যে বিত্তহীন সে যেন সঙ্গত পরিমাণে ভোগ করে। আর তোমরা যখন তাদেরকে তাদের সম্পদ সমর্পণ করবে তখন তাদের ওপর সাক্ষী রেখো। হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। (সুরা নিসা : আয়াত-৬)। অতএব এতিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এতিমের প্রতিপালন করার দ্বারা জান্নাতে উচ্চাসন লাভ হয়। জান্নাতে নবীজি (সা.) এর সঙ্গে থাকার অন্যতম একটি আমল হচ্ছে এতিম প্রতিপালনের প্রতি নিজেকে নিয়োজিত রাখা। ইসলাম সমাজের ধনবান, সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের সম্পদে নিঃস্ব, এতিম, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্তদের অধিকার নিশ্চিত করেছে। যারা এতিমকে ভালোবাসে তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রিয়নবী (সা.) সেসব লোকদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন মুসলমানদের ওই বাড়ি সর্বোত্তম যে বাড়িতে এতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর ওই বাড়ি সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে বাড়িতে এতিম আছে অথচ তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হয়। অতঃপর তিনি তার দুই আঙুল দিকে ইশারা করে বলেন আমি এবং এতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এরূপ কাছাকাছি অবস্থান করব। এতিমের সঙ্গে অন্যায় কঠোর আচরণ নিষিদ্ধ এবং এটি জঘন্যতম পাপও বটে। ইসলাম যেভাবে এতিম প্রতিপালন তার সঙ্গে উত্তম আচরণ তার সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ তাকে সঠিকভাবে শিক্ষাদান ও উপযুক্ত বয়সে তার কাছে সম্পদ প্রত্যর্পণ সব প্রকার ক্ষতি ব্যতিরেকে সার্বিক কল্যাণকামিতার নির্দেশ দিয়েছে। অনুরূপভাবে এতিমের সঙ্গে কঠোর ও রূঢ় আচরণ থেকেও কঠিনভাবে বারণ করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। (সুরা দোহা : আয়াত : ৯)
হজরত আলীর (রা.) সতর্কবাণী : ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) শাহাদতের বিছানায় শায়িত হয়ে শেষ অসিয়তে লোকদের এতিমদের ব্যাপারে সতর্ক করে বলেন সাবধান! এতিমদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এতিমদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তোমরা তাদের সমালোচনার পাত্র হয়ো না এবং তোমাদের উপস্থিতিতে তাদের কোনো ক্ষতি করো না। এতিমের সম্পদ গ্রাস করা বা দখল ধ্বংসাত্মক কাজের একটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৭টি কাজকে ধ্বংসাত্মক বলেছেন তন্মধ্যে একটি হলো-এতিমের সম্পদ গ্রাস করা।
হাদিসে এসেছে—হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার করো। সাহাবায়ে কেরাম বললেন হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কি ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা।
২. জাদু করা।
৩. অন্যায়ভাবে (বিনাদন্ডে) কোনো প্রাণ সংহার (হত্যা) করা।
৪. সুদ খাওয়া।
৫. এতিমের সম্পদ (অন্যায়ভাবে) গ্রাস করা।
৬. যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করা এবং
৭. মুমিনা পবিত্বা (সতি-সাধ্বী) নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া।
এতিমের মাথায় হাত বুলানোর কত বরকত, এতিমকে একটু আদর সোহাগ দেওয়া তার খোজ খবর নেওয়া কত মর্তবা। আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আসল এসে বলল হে আল্লাহর রাসুল আমার হৃদয় খুব কঠিন আমি কি করলে আমার হৃদয় নরম কোমল হবে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তুমি এতিমের মাথায় হাত রাখ আর মিসকিনকে খাবার দাও। এই দুই আমল হৃদয়ের কঠিন্য দুর করে দেয়।
সুতরাং কোরআন সুন্নাহর আলোকে এটি প্রমাণিত যে এতিমের অধিকার হরণ সম্পদ ভোগদখল করা শাস্তিযোগ্য মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে উম্মতে মুহাম্মাদির সবাইকে এতিমের প্রতি কোমল হওয়ার কথা বলেছেন। বেদনা ও কষ্টদায়ক আচরণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এতিমের সম্পদ ভোগ-দখল করা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। এতিমের প্রতি সুন্দর ও উত্তম আচরণ করা এবং তাদের প্রতি যথাযথ সহানুভূতি দেখানোর মাধ্যমে কবিরাহ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট