এখনও পদ বিলিয়ে যাচ্ছে ২৯১ সদস্যের মেয়াদছাড়া চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ
সর্বশেষ ঢুকলেন এক সহ-সম্পাদক ও সদস্য
নয় বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তেমন না থাকলেও কমিটিতে পদ বিতরণ ও বাণিজ্যে এককাঠি এগিয়ে। এই ধারাবাহিকতায় ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট ‘বুড়ো’ নগর ছাত্রলীগ নতুন করে ঢোকালো আরও একজন সহ-সম্পাদক, সঙ্গে একজন কার্যনির্বাহী সদস্যও।
মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনেই নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের স্বাক্ষরে মোহাম্মদ রাশেদকে সহ-সম্পাদক ও এসএম বিশালকে সদস্য পদে মনোনীত করা হয়। তবে খবরটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হল রোববার (৯ জানুয়ারি)।
তবে নগর ছাত্রলীগের হঠাৎ এই সদস্য সংযুক্তির বিষয়টিকে ‘অবৈধ ও গঠনতন্ত্রবিরোধী’ বলে মতপ্রকাশ করেছেন একাধিক ছাত্রনেতা। তারা এও বলছেন, যেখানে খোদ ইমু-দস্তগীর কমিটিরই মেয়াদ নেই, সেখানে নতুন করে সদস্য সংযুক্তিই রীতিমত হাস্যকর।
নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘নতুন সদস্য সংযুক্তির কোনো এখতিয়ার নগর ছাত্রলীগের নেই। এটা সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্রবিরোধী। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের কোনো ধারাতে কোনো ইউনিটকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তারা দেখাক, গঠনতন্ত্রের কোন্ ধারা অনুযায়ী তারা নতুন সদস্য সংযুক্তি করেছে।’
ঘটনাচক্রে রনির জায়গায় সাধারণ সম্পাদকের আসন পেয়ে যাওয়া জাকারিয়া দস্তগীর বললেন, ‘না আমরা কোন ধারাতে না, আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এই কাজ করেছি।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের সেই ‘অনুমতিপত্র’ দেখতে চাইলে দস্তগীর স্বীকার করেন, ‘এটা লিখিত না, এটা তো মৌখিক অনুমতি।’
তবে ইমু-দস্তগীরের এসব কাণ্ডকে খোলাখুলি ‘ঠগবাজি’ বলেই অভিহিত করেছেন নগর ছাত্রলীগের একাধিক শীর্ষসারির নেতা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কোনো অনুমোদন নেই এভাবে কমিটির সদস্যপদ বিতরণে। ছাত্রলীগের মতো সংগঠন কি ‘মৌখিক নির্দেশে’ চলে? মূলত মানুষকে বুঝ দেওয়ার জন্য তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নাম বিক্রি করছে— এমন অভিযোগ করেন ওই নেতারা।
নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সামদানি জনি বলেন, ‘যেখানে নগর ছাত্রলীগের কমিটিই অবৈধ, সেখানে তারা বৈধভাবে নতুন নেতা বানাবে কী করে? আমি নিজে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সাথে এ বিষয়ে কথা বলে জেনেছি নতুন নেতা বানানোর কোনো ক্ষমতা নেই ইমু-দস্তগীরের।’
তিনি বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগকে তো ইমু-দস্তগীর নিজেদের পৈতৃিক সম্পত্তি মনে করে, তাই যেমন খুশি তেমনই করছে। তবে আমি নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এতটুকু বলতে পারি এই সদস্য সংযুক্তির বিষয় ও প্রক্রিয়া দুটোই বে-আইনি ও অবৈধ।’
ছাত্রলীগ যখন প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পালন করল, ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ তখন ধুঁকছে ‘রাজনৈতিক আইসিইউ’তে। সন্ত্রাসী, বিবাহিত ও অছাত্রদের ভারে সংগঠনটির কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। ছাত্র ও অবিবাহিতদের সংগঠন হলেও বর্তমানে নগর ছাত্রলীগের ৯৫ ভাগ নেতারই নেই ছাত্রত্ব। আবার ৭৫ ভাগ নেতাই বিবাহিত।
তাছাড়াও শুধুমাত্র গত এক বছরে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ১৫ জন পদধারী নেতা বিভিন্ন অপরাধের কারণে আটক হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে শুধু একজন ছাড়া অভিযুক্ত আর কোনো নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং চিহ্নিত অনেক অপরাধীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদের ভার।
বিভিন্ন সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতারা সরাসরি জড়িত— এমন প্রমাণ মিললেও সব ঘটনার পরেই নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মুখে থাকে সেই একই বক্তব্য— ‘আমরা তদন্ত করে দেখছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবো।’ কিন্তু সেই তদন্ত কখনও শেষ হয় না। আবার অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয় কখনও। বরং অভিযুক্ত কোনো কর্মীর যদি পদবি না থাকে, তাকে পদবির ব্যবস্থা করে দিয়ে উল্টো পুরস্কৃত করার ঘটনাও অসংখ্য।
২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর কাউন্সিলের আয়োজন ছাড়াই সিলেকশনের মাধ্যমে ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর কিছুদিন পর ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়।
গর ছাত্রলীগের পদধারী অনেক নেতাকে এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে কাটাতে দেখা যায়। করোনার আগে অনেক নেতার ফেসবুকে শোভা পেতে দেখা গেছে, বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার মধুর সব মুহূর্ত। প্রকাশ্যে এই ছাত্রনেতাদের বিয়ে করতে দেখা না গেলেও কর্মীদের পক্ষ থেকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেখে হাস্যরসেরও সৃষ্টি হচ্ছে রাজনীতি অঙ্গনে। তবে কেউ কেউ আবার এতো রহস্য না রেখে সরাসরি বউ-বাচ্চাসহ ফেসবুকে হাজির হয়ে চমকে দিচ্ছেন সবাইকে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইমু-দস্তগীরের বিপক্ষে অনাস্থা প্রকাশ করেন বর্তমান কমিটির ৪৬ জন নেতা। এছাড়া নগর ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ অভিহিত করে নতুন কমিটির দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। মহানগর কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক নাছির উদ্দীন কুতুবী ওই সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ ২৯১ সদস্যের কমিটিতে ৫৬ জন বিবাহিত ও ১৬২ জনই অছাত্র।’
এদিকে ইমু-দস্তগীর কমিটির ঘোষিত ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের কমিটিগুলো নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। তৃণমূল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন— খুনের দায়ে অভিযুক্ত, কিশোর গ্যাং লিডার, মাদকসেবী থেকে শুরু করে এমনকি ফার্নিচার মিস্ত্রিকেও ছাত্রলীগের নেতা বানানো হয়েছে সেই সব কমিটিতে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া যুবলীগ নেতাকেও থানা ছাত্রলীগের সদস্য করার মত অদ্ভূত ঘটনাও ঘটেছে।
বিএস/সিপি