একজনের শতকোটির দুর্নীতি ঢাকতে তড়িঘড়ি এজিএম এসএওসিএলে

পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অধীন চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) পরিণত হয়েছে রীতিমতো লুটের ভাণ্ডারে। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কাই করছে না। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। শুধু এই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পেয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ। এরই মধ্যে শত শত কোটি টাকার অনিয়মের হিসাব আড়ালে নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটি করতে যাচ্ছে অনলাইন এজিএম। অথচ খোদ বিপিসি চেয়ারম্যানই এ বিষয়ে কিছু জানতেন না।

সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) হল দেশের জ্বালানি খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান। জ্বালানি খাতের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইস্টার্ন রিফাইনারি, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডসহ (এসএওসিএল) সাতটি প্রতিষ্ঠান বিপিসির অধীন। তবে এসএওসিএল আধাসরকারি। বাকি অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানার।

এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারের কোন নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করার অভিযোগ রয়েছে এসএওসিএলের বিরুদ্ধে। বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজনের আগে যে সকল নিয়ম মানা হয় তা না মেনে এসএওসিএল বিপিসিকে পাশ কাটিয়ে আয়োজন করতে যাচ্ছে এজিএম। ২৫ জুন অনলাইনে তারা এজিএম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে খোদ বিপিসি চেয়ারম্যানই।

এজিএমে সাধারণত সকল শেয়ার হোল্ডারসহ সব স্টেকহোল্ডার উপস্থিত থাকেন। তারা উপস্থাপিত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু ২০১৮ পর্যন্ত এসএওসিএলের এজিএম ছিল ডিনার পার্টির আয়োজন। রাতে কোন একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে সাজানো রেজুলেশনের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া হতো। এতে এসএওসিএল-এর শত শত কোটি টাকার অনিয়মের হিসাব আড়ালে চলে যেতো।

২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সামছুর রহমান বিপিসির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি এসএওসিএলের এজিএমের নামে ডিনার পার্টি বন্ধের উদ্যোগ নেন। সকল পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ২০১৯ সালের এজিএম করান তিনি। তবে তার আফসোস রয়ে গেছে, সেই এজিএম চট্টগ্রামে করতে না পারার।

সরকারের সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, এজিএম হবে এজিএমের মেজাজে। এজিএম তো ডিনার পার্টি না। জ্বালানি খাতের পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা তাদের প্রধান কার্যালয়ে এজিএম আয়োজন করে। হাজার হাজার স্টেকহোল্ডার উপস্থিত থাকে। এসএওসিএল এজিএম করতো কোন একটা হোটেলে। রাতে ডিনার শেষে সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর নিয়ে রেজুলেশন করে নিতো। তবে ২০১৯ সালে সব স্টেকহোল্ডারের উপস্থিতিতে এজিএম করা হয়েছিল। তাও ঢাকায়। কোম্পানির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে করতে পারলে পুরোপুরি নিয়ম রক্ষা হতো।

২৫ জুনের অনলাইন এজিএম সম্পর্কে জানতে চাইলে এসএওসিএল বোর্ড চেয়ারম্যান ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব আবুল মনসুর বলেন, যেহেতু এটি একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তাই আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য আমরা করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে এজিএম করতে যাচ্ছি।

এজিএমের উদ্দেশ্য অনলাইনে পূরণ হবে না জানিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান সামছুর রহমান বলেন, সত্যিকার অর্থে যে উদ্দেশ্যে এজিএম করতে হয়, তাতো অনলাইনে ফুলফিল হবে না। দেশের সকল আইনেই জাতীয় দুর্যোগের বিষয় উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট আইনেই তার প্রয়োগের বিষয়ে শিথিলতা রয়েছে। এজিএমে যেহেতু হিউজ গেদারিং হবে, তা করোনা দূর্যোগ কাটার পর করা যেতো।

২১ জুন পর্যন্ত এজিএমের বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান কিছুই জানতেন না, তাকে জানানো হয়নি। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পক্ষ থেকে বোর্ড চেয়ারম্যান আবুল মনসুরকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বিপিসি চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়ার দাবি করেন। তবে এর পরদিন অর্থাৎ ২২ জুন তড়িঘড়ি করে বিপিসি চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে। তিনি এজিএমের এজেন্ডা জানতে চাইলেও ২৩ জুন দুপুর পর্যন্ত তাকে এজেন্ডা জানানো হয়নি। অথচ নিয়ম রয়েছে সংশ্লিষ্টদের থেকে এজিএমের এজেন্ডা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয় এজিএমের আগে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এজিএম নিয়ে এমন অনিয়মের মূল কারণ এসএওসিএল মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের শতকোটি টাকার আর্থিক নিয়ম আড়াল করা। স্বাধীন বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে মোটা দাগে অর্থ লুটপাটের ইতিহাস গড়েছেন মোহাম্মদ শাহেদ। অভিযোগ পেয়ে বিপিসি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সেই কমিটি এসএওসিএল-এর ৬ বছরের হিসাব চাইলে মাত্র দুই বছরের কাগজপত্র দেখায় এসএওসিএল। ওই দুই বছরের হিসাবে ৫৭ কোটি টাকার অনিয়ম পায় বিপিসি। তখন ওই অনিয়মের দায়ে শাহেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিল বিপিসি। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন এখনো দৃশ্যমান হয়নি।

অপরদিকে হটলাইনে ফোন পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক মোহাম্মদ শাহেদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পায়। বিষয়টি স্বীকার করলেও তদন্ত চলমান থাকায় বিস্তারিত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন দুদকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা।

তবে তদন্তে বের হয়ে আসা ৫৭ কোটি টাকার অনিয়ম, দুদকের তদন্ত সবকিছুকে ছাড়িয়ে জ্বালানি খাতের ক্ষমতাধর ব্যক্তি মোহাম্মদ শাহেদ সব অনিয়মের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘সব ঠিকঠাক আছে, কোন অনিয়ম হয়নি। বিপিসি যে সুপারিশ করেছে তাও ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এজিএমও আইনি বাধ্যবাধকতায় নির্দিষ্ট সময়ে হচ্ছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!