মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দুর্নীতির দূর্গখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালকের বিশ্বস্ত ও দীর্ঘদিনের অফিস সহায়ক মো. জুয়েল। জুয়েল করেনি বা পারে না এমন কোনো অপকর্ম নেই। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও মহাপরিচালক অনড়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মহাপরিচালকের দপ্তরে কর্মরত জুয়েল। এবার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সই জাল করে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে বদলির উদ্যোগ নেওয়ায় এবার ধরা খেলেন এই অফিস সহায়ক।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত অফিস সহায়ক মো. জুয়েলকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আর অনৈতিকভাবে ঢাকার যে দুই শিক্ষককে বদলির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তাঁদের আপাতত ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে মাউশির আইন শাখা। কিন্তু কোটিপতি কর্মচারী জুয়েলকে রক্ষায় মরিয়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জুয়েলের বিরুদ্ধে সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারী বদলি, সদ্য সরকারিকৃত স্কুল শিক্ষকদের সনদ ও তথ্য বদলে দেয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্যে অপর কর্মচারী সৈয়দ লিয়াকতের সাথে সিন্ডিকেট করে বাণিজ্য করে আসছে জুয়েল। জালিয়াতি করে এমপিও পাইয়ে দেয়া, টাকার বিনিময়ে ফাইল গায়েব করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গোসাইরচরে জন্ম জুয়েলে। তার পরিবারের অনেকেই পেশাদার তদবিরবাজ ও দালাল। আর দালালি করেই ফ্ল্যাট কিনেছে মোহাম্মদপুরে। জুয়েলের বাবা ধানমন্ডি গভ. বয়েজের বেসরকারি শাখার পিয়ন। জুয়েলে কোটি টাকা ফ্ল্যাট থাকলেও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ধানমন্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের ফিডার শাখার দুইরুম নিয়ে অবৈধভাবে থাকছে।
দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজশিক্ষা দেখভাল করে মাউশি। শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি, পদোন্নতি থেকে বিভিন্ন কাজে বড় ভূমিকা রাখে মাউশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত নানা কাজ হয় এখান থেকে। বর্তমানে সারা দেশে কেবল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ই আছে ১৮ হাজার ৫৯৮ টি। এগুলো শিক্ষক আছে আড়াই লাখের মতো। এ ছাড়া কলেজ আছে সাড়ে চার হাজারের মতো। এগুলোতে শিক্ষক আছে প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার। এ ছাড়াও আছেন কর্মচারী। এই বিরাটসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন কাজে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘চক্র’ তৈরি করে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য করেন বলেও অভিযোগ। এঁদের অনেকেই আবার বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা ভবনে চাকরি করছেন। কখনো কখনো দূর দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষক-কর্মচারীরা হয়রানিরও শিকার হন।
এ রকম অভিযোগের মধ্যেই বেরিয়ে এল প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দপ্তরের অফিস সহায়ক মো. জুয়েল সম্প্রতি ঢাকার আজিমপুর গভ. গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের সহকারী শিক্ষক কে এম মাহমুদুল হাসানকে ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে এবং কুমিল্লার দাউদকান্দির বেগম আমেনা সুলতান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির সহকারী শিক্ষক ফাতেমা আক্তারকে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকার একটি বিদ্যালয়ে বদলির ‘ব্যবস্থা’ করতে যাচ্ছিলেন। আর এই কাজে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। আবেদনে শিক্ষা উপমন্ত্রীর সই জাল করে সুপারিশ লিখে সেটি নিয়ে মাউশির মাধ্যমিক শাখায় যান জুয়েল। এর আগেও তিনি এ ধরনের কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মহাপরিচালকের দপ্তরের অফিস সহায়ক হওয়ায় সন্দেহ হলেও প্রথম দিকে তেমন একটা কিছু বলতেন না মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা। কিন্তু এবার একজন কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি বেশি সন্দেহে হলে তিনি বিষয়টি তাঁর ঊর্ধ্বতনকে অবহিত করেন। এরপর সেটি শিক্ষা উপমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। এরপর বিষয়টি জেনে সই জালিয়াতির জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেন উপমন্ত্রী।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তা ও শিক্ষা ভবনের কয়েকজন কর্মচারী এবং সরকারি হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।’
জুয়েলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহাপরিচালক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে যে দুই শিক্ষককে বদলির জন্য এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে ঢাকার আজিমপুর গভ. গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের সহকারী শিক্ষক কে এম মাহমুদুল হাসানকে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের এম কে সি এম পাইলট গভ. হাইস্কুলে এবং দাউদকান্দির বেগম আমেনা সুলতান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাতেমা আক্তারকে হবিগঞ্জের মাধবপুরের গোবিন্দপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।
এমএহক