এলাচের ঝাঁজ/ গুয়াতেমালার প্রভাব খাতুনগঞ্জের বাজারে
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত। আসছে শুক্রবার ছোট মেয়ের বিয়ে। আমন্ত্রিত অতিথিদের আতিথিয়েতার জন্য খাবারদাবারের বন্দোবস্ত করার জন্য আগে থেকেই মসলার বাজারে ঢুঁ মারতে এসে হকচকিয়ে গেলেন। ঈদ সামনে ছিল বলে তখন বাজার করতে এসে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঈদ কবে শেষ হবে আর মসলাপাতি কিনবেন। ঈদের আমেজ শেষ হলেও কমেনি এলাচের দাম।
বেশ কয়েকমাস ধরে অস্থির এলাচের বাজার। মূলত প্রতি বছর কোরবানির ঈদ এলেই দরবৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে। ব্যবসায়ীরাও বাজারের চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোরবানি ঈদের সপ্তাহখানেক আগে খাতুনগঞ্জে সকাল থেকে বিকাল গড়াতেই এলাচের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ ২৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। তবে এখন কোরবানির ঈদ শেষ হলেও এলাচের উত্তাপ আগের মতোই রয়ে গেছে।
আড়তদাররা জানান, খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে মঙ্গলবার এলাচের কেজি বিক্রি হচ্ছিল ২ হাজার ৩২০ টাকা। অথচ গত এক মাস আগেও সেই এলাচ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। অর্থাৎ শুধুমাত্র কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫২০ টাকা!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন আড়তদার জানান, খাতুনগঞ্জে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী এলাচ আমদানি করেন। মূলত পুরো বাজারটাই ওরা নিয়ন্ত্রণ করেন। বাজারের অবস্থা বুঝে আমদানিকারকরা দাম ওঠানামা করেন। এক্ষেত্রে আবার ট্রেডাররাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে সকাল-বিকাল দর উঠানামায় ব্যস্ত থাকেন।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি সোলায়মান বাদশা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর বেশি থাকায় মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে গুয়াতেমালা থেকে আমদানি করা হয় এলাচ। আমদানির সময় যেসব পণ্যের দর বেশি ছিল সেগুলোর দাম স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আবার ভারত থেকে এলাচ আমদানি বন্ধ। ফলে গুয়াতেমালার এলাচের বুকিং দর ৯-১০ ডলার থেকে বেড়ে এখন ১৯ ডলারে পৌঁছেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আমদানি খরচও বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক গুলিস্তান ফিডের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বর্তমানে বাজারে এলাচ আমদানি হচ্ছে না। তাই যাদের কাছে এলাচ মজুদ আছে এগুলোই মূলত ট্রেডিং হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ভারতে এলাচের প্রতি কেজি ৩ হাজার রুপিতে বিকোচ্ছে। এ খবর খাতুনগঞ্জে চাউর হওয়ার পর থেকে হঠাৎ করে বাজারে ট্রেডিং বেড়ে যায়। ফলে এলাচের দাম বাড়তে থাকে। বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে গেলে দামও এমনিতে কমে যাবে।
খাতুনগঞ্জের কয়েকজন এলাচ আমদানিকারক জানান, বর্তমানে এলাচ আমদানি বন্ধ আছে। সাধারণত গুয়াতেমালায় সেপ্টেম্বরে এলাচের ফসল উঠে। গুয়াতেমালা থেকে এলাচ আসতে ২ মাস সময় লাগে। তাই বছরের এই সময়ের দিকে এলাচের মজুদ কমে যায়। মজুদ কমে যাওয়ায় বাজারে এলাচের সংকট দেখা দেয়। এছাড়া বছরের শেষদিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিমাণ বাড়ে। তাই বেড়ে যায় এলাচের চাহিদা। তবে নতুন এলাচ আমদানি হলে দাম অর্ধেকে নেমে যাবে।
পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি অমর কান্তি দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মসলার দাম ওঠানামা করে বুকিং ফির ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দাম বাড়লে এখানেও মসলার দাম বাড়ে। মসলাপণ্যে সাধারণত কোনো রকমের সিন্ডিকেট হয় না। মসলা আইটেম যে যার মতো করে আমদানি করে বিক্রি করেন। আর এই পণ্যগুলোর দাম ওঠানামা করে। চাহিদাকে পুঁজি করে খুচরা ব্যবসায়ীরা মসলার দাম বাড়িয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে খাতুনগঞ্জের অপর আমদানিকারক আবু মোহাম্মদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ভারতের দাম বাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার থেকে বাজার অস্থির হয়ে উঠে। বর্তমানে এলাচের সরবরাহও স্বাভাবিক আছে। সমস্যা হলো আমাদের অনেক ব্যবসায়ী হুজুগে। দেখা যায়, কেউ তেল কেনায় ঝুঁকলে সবাই এক সাথে তেলই কিনতে থাকে। এছাড়া ভারতে দাম বাড়লে আমাদের বাড়ার তো যৌক্তিকতা নেই। এখন কোরবানির ঈদ শেষ। যেহেতু চাহিদা কমে যাবে, তাই স্বাভাবিকভাবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দামও কমতে থাকবে।
কৃত্রিম সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃত্রিম সংকটের বিষয়টি সত্য নয়। কারণ বাজারে যখন যোগানের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যায় তখন অর্থনীতির নিয়মেই দাম বেড়ে যায়। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও গত মৌসুমে গুয়াতেমালা থেকে পর্যাপ্ত এলাচ আমদানি করতে পারেনি। সেখানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এলাচের বুকিং রেটও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়েছে এলাচের বাজারে।
খুচরা ব্যবসায়ী রহমান শেখ বলেন, ঈদ ছাড়াও বছরের শেষদিকে মসলার যথেষ্ট চাহিদা থাকে। পাইকারিতে দাম বাড়লে খুচরা বাজারেও দাম বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর বৃদ্ধি ও আমদানি নির্ভরতার কারণে আমদানিকারকদের কারসাজিতে এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টির কারণে মসলা সংরক্ষণেও বেশ সতর্ক থাকতে হয়।
এসআর/সিপি