এই বঙ্গজমিন ও উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক, আলেম-ওয়ায়েজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, খানকা-দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপালনে রাজা-বাদশাহদের অবদানের কথাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে ইসলামের একচ্ছত্র প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োজিত ছিলেন পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক-আলেমরাই। সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ‘সুফ’ অর্থ পশম আর তাসাউফ অর্থ পশমি বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাবসুস-সুফ)। মরমিতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন তাঁকে সুফি বলে। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বোঝায়।
আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহর (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশশাইখ ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো এটি হলো কলব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকির বা স্মরণে কলব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি–দরবেশ, কবি–সাহিত্যিক এবং দার্শনিকেরা নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা–পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের থেকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
কালক্রমে বিখ্যাত অলিদের কেন্দ্র করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে : ১. বড় পীর হজরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা ২. সুলতানুল হিন্দ হজরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি (র.) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা ৩. হজরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (র.) প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং ৪. হজরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানি সারহিন্দি (র.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা। এ ছাড়া সুহরাওয়ার্দি, মাদারিয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া নামে আরও কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে। মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে এর যাত্রা শুরু হলেও পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে সুফিবাদ। যেখানেই অশান্তি বিরাজমান, অত্যাচারী শাসক কর্তৃক প্রজা নির্যাতিত ও নিপীড়িত, সেখানেই ইসলামের শান্তি ও উদারতার বাণী নিয়ে সুফিদের আগমন ছিল অলৌকিক ঘটনা। তাদের জ্ঞানের উৎস ছিল কুরআন ও হাদিস। এ দেশের শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে তাদের খানকা পাওয়া যায়। এসব খানকা ছিল শিক্ষা ও জ্ঞানের কেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য শিষ্যরা ছুটে আসত দীক্ষা নেওয়ার জন্য। নিজ ধর্মের শ্রী বৃদ্ধির জন্য সুফিরা কখনো অন্য ধর্মের প্রতি বিরোধিতা করেননি।
সুফিদের মধ্যে অনেকে বড় আলেম ছিলেন তারা প্রত্যক্ষভাবে প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ইসলামের প্রয়োজনে শাসকশ্রেণিকে সহযোগিতা করেছেন। বাংলায় ইলিয়াস শাহী আমলে হিন্দু আধিপত্য বেড়ে গেলে সুফিদের মাধ্যমেই ইসলামের রাস্তা প্রশস্ত হয়। কখনো বা যুদ্ধে উপস্থিত থেকে হাতে অস্ত্র না নিয়ে নৈতিক ও মানসিকভাবে শিষ্যদের শক্তি জুগিয়েছেন। আদর্শ অনুসন্ধানকারীদের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য ও উদারতা তুলে ধরেছেন আর শান্তির ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অমুসলমান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও সমাজের নিপীড়িত মানুষ ইসলামের ছত্রছায়ায় নিজেকে আবৃত করেছিল। সুফিবাদে সুফিরা সন্ন্যাসীদের মতো ঘুরে বেড়ালেও সুফিবাদ আর সন্ন্যাসবাদ ভিন্ন বিষয়। সত্তা ত্যাগ বা সংসার ত্যাগ করে স্রষ্টার চিন্তায় মগ্ন থাকা সন্ন্যাসবাদ। সুফিবাদে সংসার ত্যাগের কথা উল্লেখ থাকে না সুফিরা আল্লাহর জন্য ইসলামের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সত্তা বিলিন করে নয়। পারস্য সুফিবাদের উর্বর ভূমি হলেও কালক্রমে ভারতবর্ষ পরিশেষে বাংলায় দূরদূরান্ত থেকে সুফিরা আগমন করেছিল।
আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা বাংলাদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে যেসব সুফি-সাধক এ দেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শাহ সুলতান রুমি (র.), বাবা আদম শহিদ (র.), শাহ সুলতান বলখি (র.), শাহ নিয়ামাতুল্লাহ বুতশেকন (র.), শাহ মখদুম রুপোশ (র.), শেখ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ (র.), মখদুম শাহ দৌলা শহিদ (র.) প্রমুখ। এঁরা গভীর পান্ডিত্য ও বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলেও কথিত আছে। কয়েকজন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি (র.), শাহ জালাল (র.), শাহ্ পরান (রহ.), শাহ কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.), খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহ.), শেখ আলাউল হক (র.), খান জাহান আলী (র.), শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (র.), শাহ ফরিদউদ্দিন (র.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাদের খানকার পাশে গরিব, অসহায় আর দুস্থ মানুষের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। সব ধর্মের মানুষের জন্য এ ব্যবস্থা ছিল উন্মুক্ত।
সুফিদের উৎকর্ষ নীতি আর নৈতিকতা দেখে নানা স্তরের মানুষ মুগ্ধ হতো, অনেকে তাদের দ্বারা সংঘটিত ক্রিয়াকলাপকে (শাহজালালের আজানের ধ্বনিতে গৌর গোবিন্দের প্রাসাদ ধ্বংস) অলৌকিক মোজেজা বলে আখ্যা দিত। তাদের আত্মশুদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ স্তরের,ফলে আল্লাহর কাছে চাওয়ামাত্র তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে দিতেন। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের গুরুসাধকেরা আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে যেভাবে দীক্ষা দান করতেন সেভাবে মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের মূল আদর্শ। সুফিরা নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সুফিবাদের প্রেম-ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি ধর্মনির্বিশেষে এ দেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা ‘বদর পীরের’ নাম স্মরণ করেন। শুধু তা-ই নয় নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি-মারফতি গান, গাজির গান, গাজিকালু-চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমি সাহিত্য, মাদার পীর ও সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পীর-দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত। সর্বোপরি হজরত শাহজালাল (রহ.) এবং শাহ মকদুম (রহ.) এর মাজারগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি প্রমাণ করে যে সুফি সাধকদের আধ্যাত্মিক শক্তি এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও জনমনে গভীরভাবে প্রোথিত। বাংলাদেশে সুফিবাদ আজও সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক চর্চা হিসেবে প্রচলিত থাকলেও এর সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশে সুফিবাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো বহুমাত্রিক এবং জটিল। একদিকে, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির প্রসারের ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সুফি আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে ইসলামের দৃষ্টিতে তাসাউফ বা সুফিবাদের স্বরূপকে এভাবে তুলে ধরা যায়। সুফিবাদে শরিয়তে নববির কোনো খেলাপ নেই ; পীর বা মুর্শিদকে তাজিমি সিজদা করার মতো হারাম কর্মকান নেই ; অশ্লীল গান-বাজনা, খেল-তামাশা, নেশা জাতীয় দ্রবাদি গ্রহণ-সেবন বা পান সম্পূর্ণরূপে হারাম ; তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে ‘সামা’-‘কাউয়ালি’ করা জায়েজ। সুফিবাদে ধার্মিকতা আছে কিন্তু ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই ; সংসারবিমুখতা তথা বৈরাগ্যবাদ চর্চার সুযোগ নেই কিন্তু নির্জনে মোরাকাবা-মোশাহাদা করার বিধান আছে। সুফিবাদ হচ্ছে ইমান হিফাজত করা, কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা, রিপুতাড়িত মূর্খতা, শয়তানের ক্রীড়া-কৌতুক, কামনা-বাসনা, দুশ্চরিত্রের সঙ্গ পরিহার এবং সর্বসাধারণের সেবা করার নাম।
ইসলাম প্রচারে সুফিরা অকাতরে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে আল্লাহর জমিনে কাজ করে গেছেন। সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অনেক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান (চিকিৎসালয়, আশ্রয়স্থল, লঙ্গরখানা, শিক্ষালয়) স্থাপন করেছেন। বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। সুফিদের সমসাময়িক প্রায় সব শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ভিন্ন দেশ থেকে এসে আবাস্থল স্থাপন করে এসব জনহিতকর কার্যাবলি করেছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ তাদের মাহাত্ম্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে শিষ্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। ইসলাম প্রচারে তাদের বাণী, কর্ম, ত্যাগ-তিতিক্ষা কখনো ভোলার নয়। তৎকালীন সুফি সাধক ও আলিমগণের এমন ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকান্ডের অবদানে জনসাধারণ থেকে শাসকবর্গ পর্যন্ত সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সুফিবাদের মাহাত্ম্য ও ব্যাপকতা শীষর্স্তানে পৌঁছেছিল। আল্লাহ সকলকে কবুল করুক আমিন।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট