মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে, বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় এবং সামাজিক সৌহার্দ্য সৃষ্টিতে রাখে বড় ভূমিকা। আপ্যায়ন মানে মেহমানদারি। আতিথেয়তা অর্থ অতিথিসেবা। অতিথি হলো মেহমান। যাঁর অতিথি হয় তিনি হলেন মেজবান। অতিথিসেবা ও আপ্যায়ন মানুষের অন্যতম সেরা গুণ। অতিথিপরায়ণতা উদারতা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আচরণের প্রতীক। সব নবী ও রাসুল অতিথিপরায়ণ ছিলেন। বিশেষত : মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আতিথেয়তায় ছিলেন অনন্য। তিনি দিনে অন্তত এক বেলা মেহমান ছাড়া আহার করতেন না। অতিথিপরায়ণতার আদর্শ ছিলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। অতিথিদের সামনে তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল। যেকোনো মেহমানকেই জানাতেন তিনি সাদর আমন্ত্রণ ও উষ্ণ অভ্যর্থনা। ধর্ম-বর্ণ ও শত্রু-মিত্রের ফারাক তিনি করতেন না। অতিথিদের কাছ থেকে কোনো অসৌজন্যতা প্রকাশ পেলেও ধৈর্য ধরতেন। আদর-আপ্যায়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন। বিদায়বেলায় মেহমানের হাতে তুলে দিতেন উপহার-উপঢৌকন। তার আন্তরিক আতিথেয়তায় অতিথিরা মুগ্ধ-বিস্মিত হতো। সেই মুগ্ধতা অনেক মেহমানকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছে। মেহমান পেয়ে আনন্দিত হওয়া এটা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। নবীরা মেহমান পেয়ে খুশি হতেন। তাঁদের অভ্যাস ছিল মেহমানের মেহমানদারি করা তাকে যথার্থ সম্মান করা। নবুয়ত প্রাপ্তির আগে রাসুল (সা.) এর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল। মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে বন্ধুত্বকে করে সুদৃঢ় এবং সামাজিক সৌহার্দ্য সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর কাছে পুত্র হজরত ইসহাক (আ.)এর জন্মের সুসংবাদ এবং তাঁর বংশে হজরত ইয়াকুব (আ.)আগমনের বার্তা নিয়ে কয়েকজন ফেরেশতা মেহমানরূপে এসেছিলেন। তিনি গরু জবাই করে তাঁদের জন্য মেহমানদারির আয়োজন করেছিলেন। বিষয়টি কোরআন মাজিদে রয়েছে আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইব্রাহিমের নিকট গেল। তারা বলল সালাম। তিনিও বললেন সালাম। তিনি অবিলম্বে একটি কাবাবকৃত গোবৎস পরিবেশন করলেন। (সুরা-১১ হুদ : আয়াত : ৬৯)। বাড়ি নির্মাণ করলে সেখানে মেহমানের জন্য বিশেষ ঘর বা কক্ষের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ হাদিস শরিফে রয়েছে। একজন মেহমান এক গৃহে একবারে তিন দিন থাকার হক বা অধিকার রাখেন। মেহমানদারি করলে রিজিক বাড়ে উপার্জনে বরকত হয় গৃহে শান্তি আসে জীবন সুখের হয়। অতিথি আল্লাহর রহমত নিয়ে আসেন। অতিথির সঙ্গে বরকত আসে। অতিথি দস্তরখানে তাঁর জন্য বরাদ্দ রিজিকই আহার করেন। অতিথির অছিলায় আল্লাহতাআলা আমাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন বিপদ-আপদ দূর করেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)থেকে বর্ণিত ইবরাহিম (আ.)এর কাছে প্রেরিত ফেরেশতাদের দলে হজরত জিবরাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল (আ.)ছিলেন। তাঁরা মানুষের আকৃতি ধারণ করে ইবরাহিম (আ.) এর কাছে আগমন করেন। তিনি তাদের মানুষ মনে করে তাদের জন্য আতিথেয়তার আয়োজন করেন। ইবরাহিম (আ.) ই পৃথিবীতে প্রথম মেহমানদারির প্রথা প্রচলন করেন।
আতিথেয়তার গুরুত্ব ও ফজিলত : মেহমানকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা এবং উষ্ণ অভ্যর্থনা সাদর সম্ভাষণ জানানো মেজবানের কর্তব্য। পরিবারের সদস্যদের মেহমানের পরিচয় জানিয়ে দেওয়া আত্মীয় কুটুম হলে তার সঙ্গে রিশতা বা সম্পর্ক কী তা-ও জানানো উচিত। মেহমান আসার সঙ্গে সঙ্গে পানি শরবত ও যা সহজ হয় এমন কিছু দিয়ে তাৎক্ষণিক হালকা নাশতার ব্যবস্থা করা উচিত। ঠিক খাবারের সময় বা খাবারের আগে-পরে নিকটতম সময়ে মেহমান এলে উপস্থিত যা আছে তা-ই দিয়ে আপ্যায়ন করা যেতে পারে। মেহমানের অজু-গোসলের ব্যবস্থা ও ইবাদতের সুযোগ করে দিতে হবে। ইসলামে মেহমানদারির মর্যাদা অনেক বেশি। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মেহমানদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনেক সময় অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। নিজ ঘরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে তিনি মেহমানদের কোনো ধনী সাহাবির বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। নবী হওয়ার আগে থেকেই তিনি অতিথি সেবায় সচেষ্ট ছিলেন। সর্বপ্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে যখন তিনি অনেকটা বিচলিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তখন হজরত খাদিজা (রা.) তখন তাঁকে সান্ত¡না দিয়েছিলেন এভাবে : আল্লাহ্র কসম কক্ষনো না।
আল্লাহ্ আপনাকে কক্ষনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন নিঃস্বকে সাহায্য করেন মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো জায়গায় থাকার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা এবং সাধ্যমতো উত্তম পানাহারের আয়োজন করা সম্ভব হলে মেহমানের চাহিদা ও রুচি জেনে সেভাবে সেবা করার চেষ্টা করা। অন্তত তিন দিন সুন্নাত মেহমানদারির নিয়ত করা। হজরত লুত (আ.) এর জাতিকে তাদের অবাধ্যতা পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে মেহমান বেশে সেখানে গিয়েছিলেন। হজরত লুত (আ.) এই মেহমানদের থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিষয়টি কোরআন মজিদে উল্লেখ রয়েছে আর যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা লুত (আ.) এর নিকট গেল তখন তাদের আগমনে (তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে) তিনি বিষণ্ন হলেন এবং নিজেকে তাদের রক্ষায় অসমর্থ মনে করলেন ও বললেন ইহা নিদারুণ দিন। (সুরা-১১ হুদ : আয়াত : ৭৭)
অভাব-অভিযোগ ও সমস্যার কথা মেহমানকে বুঝতে না দেওয়া দরকার যাতে মেহমান বিব্রত বোধ না করেন। এ বিষয়ে কোরআন কারিমে রয়েছে আর তারা তাদের (মেহমানদের) নিজেদের ওপর প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদের অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। (সুরা-৫৯ হাশর : আয়াত : ৯)। মেহমানদারিতে অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা মেহমানের কাছে দোয়া চাওয়া এবং আবার আসার জন্য আন্তরিকভাবে আবেদন রাখা দরকার। মক্কা বিজয়ের পর মদিনায় অতিথির কোনো অভাব ছিল না। রাসুল (সা.) নিজেই তাদের খেদমত আঞ্জাম দিতেন। আর সাহাবি বিলাল (রা.)কে রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত করেন। সুতরাং মুমিন মুসলমানের প্রত্যেকেরই উচিত মেহমানদারির হক ও নিয়মগুলো মেনে চলা। কুরআন-সুন্নায় ঘোষিত ফজিলত ও মর্যাদাগুলো অর্জন। আবার অযথা কাউকে কষ্ট না দেয়া থেকেও বিরত থাকা জরুরি।
রাতের মেহমান ঋণস্বরূপ : মিকদাম আবু কারিমা আস-সামি (রা.) থেকে বর্ণিত-নবী (সা.) বলেছেন রাতের বেলা আগত মেহমানের মেহমানদারি করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। আর রাতের বেলা তার কাছে মেহমান অবস্থান করলে সে তার জন্য ঋণস্বরূপ। এখন সে ইচ্ছা করলে এই ঋণ (মেহমানকে পানাহার করানো) পরিশোধ করুক অথবা চাইলে তা ত্যাগ করুক।
বিদায়কালে মেহমানকে কিছু হাদিয়া : বিদায়কালে মেহমানকে কিছু হাদিয়া বা উপঢৌকন দেওয়া যেতে পারে। মেহমানের পথের জন্য পাথেয় বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবারদাবার বা অন্য কোনো সামগ্রী উপহার দেওয়া যেতে পারে। যে ঘরে মেহমানের আগমন বেশি হয় সে ঘরে আল্লাহর রহমতের বর্ষণ বেশি হয়। কারও এটা ভাবা উচিত নয় যে মেহমান আসার কারণে মেজবানের রিজিক কমে যায়। রিজিক কমে যায় না বরং তাদের ভাগ্যে আল্লাহতাআলা সৃষ্টির আগেই এই রিজিক লিখে রেখেছিলেন। মহানবী (সা.) বলেছেন তোমরা তোমাদের অতিথির যথাযথ প্রাপ্য প্রদান করো। মেহমানদের সেবা করা অবশ্যকর্তব্য। এটা আল্লাহতাআলার আদেশ ও নবীর সুন্নত।
মেহমান হয়ে কতদিন থাকব : হজরত আবু আবু শুরাইহ খুযাঈ (রা.) এর বরাতে এই হাদিসের বর্ণনা আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মেহমানদারি তিন দিন আর উত্তম মেহমানদারি একদিন –একরাত্রি। কোনো মুসলমানের জন্য এটা বৈধ নয় যে সে তার ভাইয়ের কাছে থেকে তাকে দিয়ে পাপ করাবে। সাহাবারা বললেন হে আল্লাহর রাসুল কীভাবে সে তাকে দিয়ে পাপ করাবে ? তিনি বললেন সে (মেহমান) তার কাছে (বেশি দিন) থাকবে অথচ তার (মেজবানের) এমন সামর্থ্য নেই যা দিয়ে সে তার মেহমানদারি করবে।
মেজবান ও তাঁর বাড়ির জন্য কিছু হাদিয়া : মেজবান ও তাঁর বাড়ির জন্য কিছু হাদিয়া বা উপহার নিয়ে যাওয়া মেহমানের জন্য সুন্নাত। মেজবান যেভাবে আতিথেয়তা করবেন এবং যা আপ্যায়ন করবেন খুশি মনে তাতে সন্তুষ্ট থাকা সুন্নাত। খাবারের যত পদ পরিবেশন করা হবে সব পদ থেকে সামান্য করে হলেও গ্রহণ করা উচিত। খাবারের দোষ বর্ণনা না করা এবং আতিথেয়তা আপ্যায়নের ত্রুটি না ধরা সুন্নাত। এমন কোনো আচরণ না করা যাতে মেজবান বিরক্ত বা বিব্রত হন। মেজবানের পরিবারের সদস্য বা অন্য কোনো আত্মীয় বা পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে মেজবান পরিচয় না করিয়ে দিলে আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা না বলা এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করা উচিত। এমন কোনো কিছু না করা যাতে মেজবানের অমর্যাদা হয়। প্রিয় নবী (সা.) এর আতিথেয়তা মুসলমানদের অনুপম আদর্শ। আধুনিক যুগেও এসব সুন্নাহই আভিজাত্যের নিদর্শন। এসব সুন্নাহ থেকে মুসলমানরা নিত্য দূরে সরে যাচ্ছে। তাই আসুন মেহমানের সমাদর করি। তাদের খাতির-যত্ন ও আদর-আপ্যায়নে সুন্নতের অনুসরণ করি। ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিই পৃথিবীময়। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট