একজন আলেম দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেলে মানুষ যেমনি দিশেহারা হয়ে যায় ঠিক তেমনি কোনো আলেম চলে গেলে পুরো দেশ ও সমাজ দিশেহারা হয়ে যায়। এসব আলেম-ওলামা না থাকলে পৃথিবী ঠিক থাকবে না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবীর সব মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে চতুষ্পদ জন্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। তাই ইসলামে আলেম-ওলামাদের সম্মান ও মর্যাদা সর্বোচ্চ। যারা প্রকৃত আলেম তাদের মর্যাদা আল্লাহর দরবারে অতি উচ্চে। সাধারণ মানুষের মাঝে আলেমরা হলেন নক্ষত্র রাজিতুল্য। যাদেরকে অনুসরণ করার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথের সন্ধ্যান লাভ করে থাকে। আলেমরা আল্লাহর ওলি বা বন্ধু। তাঁদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার শামিল। হাদিসে কুদসিতে আছে আল্লাহতাআলা বলেন যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সঙ্গে শত্রুতা করবে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। আলেম-ওলামাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দানের মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রিয় নবীজি (সা.) মহব্বত লাভ করা সম্ভব।
নবী-রাসুলদের উত্তরাধিকার : আল্লাহতাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের সম্মানিত করেছেন ওহির জ্ঞান ও জীবন-বিধান দিয়ে। সেই ওহির জ্ঞান ও বিধি-বিধান মানবজাতির কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি প্রেরণ করেছেন যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল। তাঁরা ছিলেন জগত্বাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় করুণা ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমতের সেই নবুয়তি ধারা আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয়েছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে। তিনি শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনো নবী এই দুনিয়াতে আগমন করবেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলেমদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন নিশ্চয় আলেমরা হলেন নবীদের উত্তরাধিকারী।
আলেমরা সম্মানিত : উবাদা ইবনে সামেত (রা.)-থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।
মৃত্যুর পরও আলেমের নেক আমল জারি থাকে : মানুষ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আলেমের আমল জারি থাকে। একজন আলেম জীবিত অবস্থায় ইলম বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হয়েছেন। সেজন্য মৃত্যুবরণ করার পরও তার সওয়াব তিনি পেতে থাকবেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে : সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।
সকল সৃষ্টি আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে : কুরআন-সুন্নাহর ইলমে সমৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য বড়ই সুসংবাদ যে তার জন্য আল্লাহর নিকট সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও। আল্লাহতায়ালা আলেমদের শান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-আল্লাহ তায়ালা স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন যে তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং ফেরেশতাগণ আলেমগণ ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর।
আলেমদের আনুগত্য : তাঁরা আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছেই মানুষ লাভ করে কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞান। চিনতে নিজের প্রভুকে শিখতে পারে আল্লাহর বিধি-বিধান। বুঝতে পারে শরিয়তকে। মানতে পারে হালাল-হারামকে। তাঁদের মাধ্যমেই মানুষ খুঁজে পায় নিজের আসল পরিচয়। যাঁদের সংস্পর্শে এসে অন্ধকার জগতের মানুষগুলো সন্ধান পায় আলোকিত জীবনের। মৃত হৃদয়গুলো হয় পুনর্জীবিত। তাঁরা পৃথিবীর জন্য রহমত। তাঁরা উম্মতের জন্য বরকত। ইরশাদ হয়েছে হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো অনুসরণ করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বসম্পন্ন (ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আলেম) তাদের।
আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা : আলেমদের কাছে ইসলাম সবার আগে। তাঁরা দ্বিনের অতন্দ্র প্রহরী। দ্বিন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট। তাঁরা নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে সব ধরনের বাতিল মতবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য সর্বদা অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যান। তাঁরা হক কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জান-মাল ব্যয় করাটা গৌরব মনে করেন। বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করতে কালক্ষেপণ করেন না। তাঁদের হাতেই জিন্দা হয় সুন্নত। দূরীভূত হয় বিদআত। যেকোনো শরয়ি সমস্যা নিরসনে তাঁদের দ্বারস্থ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই। তিনি ইরশাদ করেছেন অতএব আলেম-জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো যদি তোমাদের জানা না থাকে।
হাদিসের আলোকে আলেমদের মর্যাদা : উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন বৃদ্ধ মুসলমান কোরআনের আদব রক্ষাকারী ও কোরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেজ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহর সম্মান করা মহান আল্লাহর সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত।
আলেমদের সমালোচনা ও গালি দেওয়ার পরিণতি : ইমাম হাফেজ আবুল কাসেম ইবনে আসাকির (রহ.) বলেন হে ভাই জেনে রাখো উলামায়ে কেরামের দোষ চর্চা করা বিষাক্ত জিনিস। আল্লাহ তাআলার অভ্যাস হলো উলামায়ে কেরামের কুৎসা রটনাকারীকে তিনি লজ্জিত করেন (এটা কারো অজানা নয়)। যে ব্যক্তি উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করবে আল্লাহ তার মৃত্যুর আগে তার অন্তরকে মৃত বানিয়ে দেবেন। আলেমের সঙ্গে দুশমনি ও গালি দেওয়ার কারণ দুটি হতে পারে। যথা-১. ব্যক্তিগত কোনো কারণে। ২. আলেম হওয়ার কারণে। কোনো আলেমকে আলেম হওয়ার কারণে গালি দেওয়া তাঁর সঙ্গে শত্রুতা বা বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা একটি কুফরি কাজ। এটি খুবই ভয়াবহ মানসিকতা। এমন মানসিকতা লালনকারী ব্যক্তি তাওবা না করলে ঈমানের সঙ্গে তার মৃত্যু হবে কি না ঘোর সন্দেহ আছে।
আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্যদাতা : যুগে যুগে যাঁরা এই নবীদের জ্ঞান ধারণ করে আসছেন তাঁরাই যুগের হক্কানি উলামায়ে কেরাম। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী শাস্ত্রের সুবিন্যস্ত বিশাল বিশাল গ্রন্থাবলি। আল্লাহতাআলা তাঁদের বানিয়েছেন নিজ একত্ববাদের অন্যতম সাক্ষী। তিনি ইরশাদ করেছেন ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। ফেরেশতারা এবং ন্যায়নিষ্ঠ আলেমরাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। (সুরা : আলে ইমরান : ১৮)। হজরত আবুবকর রা. বলেন আমি রাসূল (সা.) কে বলেতে শুনেছি যে হয়তো তুমি আলেম হও অথবা তালেবে এলেম হও অথবা মনোযোগ সহকারে এলেম শ্রবণকারী হও অথবা এলেম আলেমের মহব্বত করনেওয়ালা হও। (এই চার প্রকার ব্যতীত) পঞ্চম হয়ো না নতুবা ধ্বংস হয়ে যাবে। পঞ্চম প্রকার এই যে তুমি এলেম ও আলেমদের সহিত শত্রুতা পোষণ করো।
আলেমদের বিরুদ্ধাচারণের কুফল : ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও মুসলমানদের বিশুদ্ধ পথে পরিচালনা করার জন্য যে আলেমরা নিজেদের সর্বস্ব কোরবান করেন তাদের প্রতি অবজ্ঞা বা ধৃষ্টতা প্রদর্শন করলে তাদের নিয়ে উপহাস বা ঠাট্টা করলে বা বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করলে এর পরিণতি হবে ভয়ংকর। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত : আলেমদের রক্ত বিষাক্ত। যে তার ঘ্রাণ নিবে সে অসুস্থ হয়ে পডবে। যে তা ভক্ষণ করবে সে মারা যাবে। আলেমদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার নামান্তর। যে আলেমের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করে সে যেন স্বয়ং আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত হল। অতএব ইসলামি বিধি-বিধানের প্রকৃত মূল্যবোধ বজায় ও জাগরিত রাখার জন্য আলেম-ওলামাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আস্থাশীল হতে হবে। তাদের প্রতি মান্যতা থাকতে হবে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা যাবে না। বিরুদ্ধাচারণ করা যাবে না। কারণ আলেমদের বিরোধিতা করা ইসলাম বিরোধী হওয়ার নামান্তর।
নবীজি (স.) এই দুনিয়ায় পুনরায় আগমন করবেন না। তবে তিনি রেখে গেছেন একদল সোনালি মানুষ। যাঁদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন ‘রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়ারাদু আনহু’ (অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট আল্লাহ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট)। তাঁদের বলা হয় ‘সাহাবা’। তাঁরা রাসুলুল্লাহ (স.) এর প্রথম উত্তরাধিকারী। সাহাবায়ে কেরামের পর এই আসমানি সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছেন তাবেয়িগণ। এরপর তাবে-তাবেয়িগণ। এভাবেই চলমান রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আসমানি আমানত রক্ষার পবিত্র ধারা। আল্লাহ যত দিন চাইবেন এ ধারা বহমান থাকবে। যুগে যুগে যাঁরা এই আসমানি আমানত রক্ষা করে আসছেন তাঁরাই যুগের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে তাফসির, হাদিসসম্ভার, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামি জ্ঞানের সুবিন্যস্ত ভানার। তাঁদের কাছে ইসলাম সবার আগে। তাঁরা দীনের অতন্দ্র প্রহরী। দীন রক্ষার ঢাল ও সুদৃঢ় প্রাচীর। ইসলামের বিরুদ্ধে সব ধরনের ষড়ষন্ত্রের মোকাবেলায় তাঁরা সর্বদা সচেষ্ট।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা মোটেও বলা অভুক্তি হবে না যে আলেম-ওলামাদের মর্যাদা ও সম্মান আকাশতুল্য। তাদের সাথে বেয়াদবি তাদের কষ্ট দেয়া ও নির্যাতন করা অত্যন্ত গোনাহের কাজ। এর জন্যে দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন মুসিবতের সম্মুখীন হতে হবে। অতএব যারা আলেম-ওলামা তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দানে পরকালে আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রিয় নবীজি (সা.) মহব্বত লাভ করা সম্ভব। আল্লাহ সবাইকে কবুল করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট