‘…আবার আরেকদিকে নিছে। হেইখানে দেখি একটা ছোট ইয়া আছে— মেশিন। একটা ছেলে ওখানে গেছে আমার সাথে। ভোট দেওয়ার একটা সিস্টেম আছে আমার ভোট আমি দেবো আর কেউ দেখবে না। উনি বলে যে, এইখানে নৌকায় মারো। আমি বললাম, আমি নৌকায় কেন মারবো। আমি যেখানে খুশি সেখানে মারবো। এটা তো মনের ব্যাপার। আমি ভোট দেবো, আমিই দেখবো।’
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন টেকবাজার হাজী কালা মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের একজন ভোটার এভাবেই জানালেন ইভিএমের ভোট কিভাবে নেওয়া হচ্ছে সেই চিত্রের খানিকটা। ‘কারচুপি’র সুযোগ না থাকলেও এভাবেই চলছে চট্টগ্রাম ৮ আসনের ভোট্গ্রহণ।
এভাবে ‘একটা ছেলে’র আড়ালে চান্দগাঁও-বোয়ালখালীর প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে। নির্বাচন কমিশন নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সম্মতিতেই তারা প্রকাশ্যে ভোটারদের ইভিএম মেশিনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইভিএম মেশিনের ‘সবুজ বোতাম’ তারাই চেপে দিয়েছেন। এর মধ্যেই ভোটারদের যারা এভাবে ভোট দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন, তাদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে গোপন কক্ষের ভেতরেই।
৬০ বছর বয়সী ভোটার মোহাম্মদ রফিক। ভোট দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার পর সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার তার স্মার্ট কার্ড চেয়ে নেন। কার্ড ইভিএমএ প্রবেশ করাতেই রফিকের ভোটার সম্পর্কিত সব তথ্য স্ক্রিনে ভেসে উঠে৷ এরপর রফিকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভোটার সনাক্তকরণ নিশ্চিত করতেই একজন গোপন বুথে প্রবেশ করে ভোটটি দিয়ে দেয়। রফিককে জানানো হয় তার ভোট হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ রফিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বললেন, ‘টিপ দিছি। আঁর কার্ড ইয়্যান মেশিনর ভিতর দিইয়ে। আঁরে হয়দে তোমার ভোট হয়ে গেছে তুমি চলে যাও।’ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে রফিক উত্তর দিলেন ‘মার্কাও মার্কা ন দেহি, ভোট ক্যানে অইলো।’
প্রকৃতপক্ষে চান্দগাঁও-বোয়ালখালী নির্বাচনী আসনের প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল আওয়ামী লীগ কর্মীদের দখলে। কার্যত তারা ছিলেন মারমুখী। দেখা গেছে, কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের লাইন। সেখান থেকে দেখে দেখে লোক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রতিটি বুথ তদারকি করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একাধিক কর্মী। একাধিক ভোটারকে ভোট দানের গোপন কক্ষে নিয়ে গিয়ে তাদের সামনে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করছেন। কথা না শুনলে সেখানেই ভোটারকে মারধর করার ঘটনাও ঘটেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রের অদূরেই জটলা বেঁধে অবস্থান অবস্থান করছে নৌকার কর্মীরা। তারা ভোটারের পরিচিতি নিশ্চিত হয়েই কেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছে। কেউ যদি ভোট নিজের অধিকার জানিয়ে ভোট দিতে যেতে চান তখনই মারধর করা হচ্ছে। নৌকায় ভোট দেবে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়েই কেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছে ভোটাররা। বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলা হচ্ছে, ওপরের নির্দেশ নৌকা ছাড়া কেউ যেতে পারবে না। এরকম চিত্র নগরীর মোহরা ও চান্দগাঁও ওয়ার্ডের অধিকাংশ কেন্দ্রেই। সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণের পর ভোটার উপস্থিতি থাকলেও ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই কেন্দ্র ভোটার শূন্য হয়ে পড়ে।
কেন্দ্রে ধানের শীষসহ অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্রের আশপাশে ঘেঁষতে না পারলেও বুথ থেকে শুরু করে সর্বত্র বিচরণ ছিল নৌকার সমর্থকদের।
নগরীর মোহরা চান্দগাঁও পাঁচলাইশ এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকার সমর্থকরা কয়েকজন মিলেই ফাঁকা বুথে নৌকায় ভোট দিতে চেষ্টা করলেও তাতে বাধা দিচ্ছেন না নির্বাচনী কর্মকর্তারা। তবে আঙুলের ছাপ না মেলাতে তারা দিতে পারছেন না। এ সময় চান্দগাঁওয়ের একটি কেন্দ্রে অবস্থান করে দেখা যায়, ইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, লিমিট ৯ ভাগের বেশি দেওয়া যাবে না, আপনার জেনুইন ভোটার আনেন। এ সময় নৌকার সমর্থকরা একে অন্যের দিকে থাকিয়ে থেকে হতাশ হয়ে পড়েন। পরে নৌকার ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে বারবার তাগাদা দেওয়া হয়।
সিপি