ইবিএলে ১১ কোটির ‘প্যাঁচ’, সেই গ্রাহকের বিরুদ্ধেই এবার ২০০ কোটির মানহানির মামলা
চট্টগ্রামে ইস্টার্ন ব্যাংকের (ইবিএল) এক গ্রাহক তার ১১ কোটি টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ তুলে মামলা করার পর ব্যাংকটি এবার ওই গ্রাহকের বিরুদ্ধেই ২০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা ঠুকে দিয়েছে। চট্টগ্রামভিত্তিক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী ওরফে ডিসকো শওকত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।

গত মঙ্গলবার (৪ মার্চ) ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মানহানির মামলাটি দায়ের করলেও ইবিএল কর্তৃপক্ষ সেটি প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার। এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ারের আদালতে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মুর্তজা আলী তার ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ইবিএল চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী প্রকাশ ডিসকো শওকত এবং ব্যাংকটির কর্মকর্তাসহ মোট ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলার বাদী মুর্তজা আলী ভাইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক। চট্টগ্রামের আদালত তার মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রামভিত্তিক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী ওরফে ডিসকো শওকত ছাড়াও ওই মামলার অন্য আসামিরা হলেন ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার, পরিচালক এম গাজিউল হক, সেলিনা আলি, আনিস আহমেদ, মুফাক্কারুল ইসলাম খসরু, গাজী মো. সাখাওয়াত হোসাইন, কে জে এস বানু, জারা নামরীন, ড. তাওফিক আহমেদ চৌধুরী, রুসলান নাসির, কে এম তানজিব উল হক, খন্দকার আতিক-ই রাব্বানী, মাহরীন নাসির, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহেদী জামান, রিয়াদ মাহমুদ চৌধুরী, এম খোরশেদ আনোয়ার, মাহমুদুন নবী চৌধুরী, এম খোরশেদ আলম, মহিউদ্দিন আহমদ, ইউনিট হেড মো. ওবাইদুল ইসলাম, মাহদিয়ার রহমান, মো. মাইনুল হাসান ফয়সাল, ট্রানজেকশন ব্যাংকিং হেড মো. জাবেদুল আলম ও হেড অব কর্পোরেট বিজনেস সঞ্জয় দাশ।
এছাড়া আসামি করা হয়েছে— ব্যাংকটির হেড অব প্ল্যানিং আশরাফ উজ জামান, চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মাসুদুল হক সরদার, হেড অব ট্রেড অপারেশন মো. মোকাদ্দাস, হেড অব ব্যাংকিং মো. জাহিদ হোসাইন, হেড অব বিজনেস সৈয়দ জুলকার নাইন, হেড অব ডিজিটাল ফিন্যান্স আহসান উল্ল্যাহ চৌধুরী, চিফ টেকনোলজি অফিসার জাহিদুল হক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. আবদুস সালাম, হেড অব কমিউনিকেশন জিয়াউল করিম, হিউম্যান রিসোর্সের প্রধান মনিরুল ইসলাম, হেড অব বিজনেস ইনফরমেশন মাসকুর রেজা, হেড অব ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট মোস্তফা সরওয়ার, কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, চান্দগাঁও শাখার ব্যবস্থাপক পারভেজ আলম, নিজাম উদ্দিন, ওআর নিজাম রোড শাখার ব্যবস্থাপক গোলাম মাইনুদ্দিন, কর্পোরেট এরিয়া হেড ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী এম এ কিউ সরওয়ার এবং সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অডিট প্রধান মো. রেজাউল ইসলামকে।
মামলায় অভিযোগে মুর্তজা আলী জানান, ২০১৭ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্টার্ন ব্যাংকের ওআর নিজাম রোডের শাখায় পাঁচ কোটি ২০ লাখ টাকা সঞ্চয়ী হিসাবে জমা করেন। কিন্তু ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সঞ্চয়ী হিসাবের ওপর ৭ শতাংশ মুনাফা পাওয়ার কথা থাকলেও ব্যাংক তাকে সেটা দেয়নি। পরে ব্যাংকে থাকা টাকার পরিমাণ মুনাফাসহ ছয় কোটি ১০ লাখে দাঁড়ালে মর্তুজা আলী সেটা ইস্টার্ন ব্যাংকের চান্দগাঁও শাখায় স্থানান্তর করেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মর্তুজা আলী ইস্টার্ন ব্যাংকের চান্দগাঁও শাখায় পাঁচ কোটি ৮০ লাখ টাকার ছয়টি এফডিআর (স্থায়ী আমানত) খোলেন এবং তার বিপরীতে একটি ওএসডি (সিকিউরড ওভারড্রাফট) ঋণের জন্য আবেদন করেন। ২০১৯ সালে বিদেশে থাকার সময় তিনি ব্যাংকটির চান্দগাঁও শাখায় তার নামে দুটি জাল সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট ও চারটি জাল ঋণ অ্যাকাউন্টের বিষয়ে জানতে পারেন। তার জাল স্বাক্ষর ও ভুল তথ্য দিয়ে ওই অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৭ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে এবং পাঁচ কোটি ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মর্তুজা আলী জানান, তার সকল পাওনা পরিশোধ করতে ইস্টার্ন ব্যাংক বরাবর লিখিত আইনি নোটিশ পাঠালেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মর্তুজা আলী ইস্টার্ন ব্যাংক থেকে সব মিলিয়ে ১১ কোটি টাকা পাবেন বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করেন তিনি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হেলাল বিন মঞ্জুর তামিম বলেন, ‘ব্যবসায়ী মর্তুজা আলী তার ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা করেন। এ ছাড়া সঞ্চয়ী হিসাবে ৫০ লাখ টাকা জমা ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদসহ উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে বিভিন্ন নাম এবং ভিন্ন ভিন্ন মোবাইল নম্বর দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন। সেই অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করে বাদী বিদেশে থাকা অবস্থায় তারা এফডির বিপরীতে ঋণ নেয়। যা বাদি জানতেন না।’
এদিকে বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) ইস্টার্ণ ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ভুক্তভোগী গ্রাহক মর্তুজা আলীর বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়েরের কথা জানিয়ে বলেছে, ‘চান্দগাঁও ব্রাঞ্চের গ্রাহক মোর্তোজা আলী অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৪৬ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলার জন্য পিটিশন জমা দেন। পিটিশনে ভিত্তিহীনভাবে ইস্টার্ণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। পিটিশনের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর ফলে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ হিসেবে মোর্তোজা আলীর বিরুদ্ধে ইস্টার্ণ ব্যাংক মানহানির মামলাটি দায়ের করেছে।’
ইবিএলের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রাহক মো. মোর্তোজা আলীর বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন।
এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার দাবি করেন, বিষয়টি ২০১৭ সালে সংঘটিত একটি তহবিল আত্মসাতের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ব্যাংকের একটি শাখার সাবেক কর্মকর্তা বহিরাগত প্রতারকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে করেছিলেন। ওই ঘটনায় ব্যাংক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দোষী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলাও করে। পরবর্তী সময়ে আদালত তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডসহ আর্থিক জরিমানা আরোপ করেন।
সিপি