প্রতিদিন ডেস্ক : চিরাচরিত ‘ঈদ’ বানানে দীর্ঘ-ঈ বাদ দিয়ে হ্রস্ব-ই ব্যবহার করে ‘ইদ’ করার প্রস্তাবে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পিছু হটেছে বাংলা একাডেমি। রোজার ঈদের ঠিক আগে আকস্মিক এই প্রস্তাবে বিতর্কের ঝড় উঠলে বৃহস্পতিবার ফেসবুক পেইজে পোস্ট দিয়ে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান লিখেছেন, ‘ঈদ’ বানানটি বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে।
একাডেমির মহাপরিচালক লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে প্রথম বানান হিসাবে ‘ঈদ’ এবং বিকল্প বানান ‘ইদ’ দেয়া আছে। প্রথম বানানটি প্রচলিত; ২য় বানানটি সংস্কারকৃত। কোনো মানুষ দীর্ঘকাল কোনো বানান ব্যবহার করলে তা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। ‘ঈদ’ বানানটি তেমনি। অতএব, দুটি বানানই ব্যবহার করা যায়।’
শেষ পর্যন্ত ‘ঈদ’ বানান নিয়ে বিবৃতি দেয়ায় শামসুজ্জামান খানকে ধন্যবাদ নিয়ে সেই পোস্টে নুরুন্নবী বেলাল নামের একজন সাহিত্যপ্রেমি মন্তব্য করেন-‘আংশিকভাবে ধন্যবাদ স্যার, বিষয়টি আংশিক খোলাসা করার জন্য, তবে ঈদ যেহেতু আরবি শব্দ আইন+ইয়া+দাল= ঈদ, সেহেতু এটার সংস্কার না করলেও চলত, কারন আরবিতে ইদ-এর অন্য অর্থ আছে!’
এর জবাবে শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘সমস্যা হলো আরবি ব্যাকরণ আর বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম এক নয়। আরবি ব্যাকরণের নিয়ম এক্ষেত্রে মানলে বহু ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে।’
দুদিন ধরে দেশের সচেতন মহলে ঈদ বানান পরিবর্তনে বাংলা একাডেমির প্রস্তাবে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশের ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনে। সাহিত্য সমালোচক, কবি ও ভাষাতাত্ত্বিক সাখাওয়াত টিপু তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘’ইদ’ নয়, লিখুন ‘ঈদ’। ‘ইদ’ শব্দ ভুল! এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার শব্দ তার ভাব ও ধ্বনিগতভাবে শব্দ আত্তীকরণ করে। গায়ের জোরে শব্দ বিকৃতকরণ ভাষার ফ্যাসিবাদ। এটা বল প্রয়োগের সংস্কৃতি!’
সাখাওয়াত টিপু আরেকটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঈদ’ বানান এভাবে ‘ইদ’ বললে ‘ইঁদুর ইঁদুর’ কালচার মনে হয়। আরবি ‘ঈদ’ মানে ‘আনন্দ’। কিন্তু ‘ইদ’ মানে কি আনন্দ’?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহেল রাজীব লিখেছেন, ‘একসময় বিদেশি শব্দ উধপপধ থেকে উযধশধ করা হয়েছে, তাতে ঢাকা ঢাকা পড়েনি। বিদেশি শব্দের বাংলা ভাবানুবাদে, অনুবাদে বা আক্ষরিক অনুবাদে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। এখন তিন দশক ধরে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ নির্ধারিত তারিখ, কিন্তু পহেলা বৈশাখ নির্ণিত হতো পঞ্জিকা অনুসারে। পার্শ্ববর্তী বাংলা অঞ্চলে (ভারতের একটি প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ) পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল। এই ১৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা নিয়ে কোনো প্রভাব বৈশাখে আসেনি। সুতরাং বিদেশি শব্দ ঈদ, ইদ হলে ঈদের/ইদের আচারে প্রভাব পড়বে না। পরার/পড়ার কথা না। পড়া ও পরা নিয়ে তর্ক হতে পারে!’
এক প্রশ্নের জবাবে রাহেল রাজীব বলেন, ‘দুটোই শুদ্ধ। তবে ‘ঈদ’ ব্যবহার বাঞ্ছনীয়, ‘ইদ’ ব্যবহারও শুদ্ধ। তবে প্রেফারেন্স পাবে ঈদ। বিদেশি শব্দের বানানের ক্ষেত্রে আমরা তেমন নিয়ম মানি না। কারণ সেই ভাষাজ্ঞান আমাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাসা ভাসা পর্যায়ের। ইংরেজি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, স্প্যানিশ কিংবা অন্যান্য বানানের ক্ষেত্রে সহজাত প্রচলিত বানানকেই গ্রহণ করা হয়ে থাকে। আইপিএ তে বিদেশি শব্দের বাংলা শব্দ করলে অনেক সময় উচ্চারণ অযোগ্য শব্দবন্ধ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাই বিদেশি ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত বানানকে অনুসরণ করা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারের জন্য যৌক্তিক’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ঈদ’ বানানে হ্রস্ব-ই ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে অভিধানে। বাংলা একাডেমি একটি প্রস্তাব করেছে। এটি মান্য করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। বানানের ব্যাপারটি পরিবর্তনশীল। এককালে বানান একরকম থাকে, পরবর্তীকালে, উত্তরকালে সেই বানান পরিবর্তিত হয়ে যায়। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ‘কার্তিক’ বানানে আমরা দুটো ত ব্যবহার করতাম, পূর্ব বানানে রেফ-এর পর দুটো ব ব্যবহার করতাম। কিন্তু ১৯৩৬-এর পর একটা ব ব্যবহার করতাম। এ রকম বহু বানান পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন আরবি, জাপানি, ফরাসি ইত্যাদি বানানে আগে দীর্ঘ-ঈ ব্যবহার করা হতো, এখন আমরা হ্রস্ব-ই ব্যবহার করি। বাংলা একাডেমি যেটি বলতে চায় সেটি হলো, বিদেশি শব্দের অন্তিমে সব সময় হ্রস্ব-ই ব্যবহার করতে হবে। কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী যেমন চীন শব্দে হ্রস্ব-ই ব্যবহার করে চিন লিখে, গ্রীক তারা লেখে গ্রিক হিসেবে’।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘ-ঈ ব্যবহার করতেন। তাহলে কেন ঈদ বানান হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখার প্রস্তাব আসল? এর জবাবে তিনি বলেন, ঈদ শব্দটি বাংলার এবং বাঙালির উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো বানান থাকে যার পরিবর্তন হলে চোখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। এর ফলে সমাজে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। ফেসবুকে অনেকেই এর প্রতিবাদ করে লিখছে। আমার মনে হয় কিছু কিছু শব্দ ব্যতিক্রম বানান নিয়ে থাকতে পারে। যেমন ঈদ এর বেলায় এমনটি হতে পারে। ঈদ বানান যেহেতু আমাদের অপটিকস সহ্য করে নিয়েছে, তাই আমার মনে হয় ঈদ বানান অপরিবর্তিত রাখলে অধিকাংশ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে’। – ঢাকাটাইমস