ইঞ্জিন সংকটে চট্টগ্রাম রেল, সচল ৫২ ইঞ্জিন, ৪৫টিতেই নেই ‘চলার ক্ষমতা’

ব্যবহার হচ্ছে ৭১ বছরের পুরোনো ইঞ্জিন

বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগে কাটছে না ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) সংকট। পাকিস্তান আমলে আনা ইঞ্জিন এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে চট্টগ্রামে। এছাড়া বর্তমানে যেসব ইঞ্জিন ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো বেশিরভাগই দুই থেকে তিন যুগের পুরোনো। তবে এরমধ্যে কয়েকটি রয়েছে যেগুলোর বয়স ৭১ বছর ছাড়িয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে এখনও পর্যন্ত আসা ১৭৯টি ইঞ্জিনে মধ্যে ৯৭টি আছে পাহাড়তলীর লোকোমোটিভ কারখানায়। কিন্তু এর মধ্যে সচল মাত্র ৫২টি ইঞ্জিন, বাকিগুলোও মেরামতের অপেক্ষায় অকেজো পড়ে আছে। এসব পুরোনো ইঞ্জিন মেরামতে প্রতিবছর রেলের লাখ লাখ টাকা গচ্চা যাচ্ছে।

চট্টগ্রামে প্রথম ইঞ্জিন আসে ১৯৫৩ সালে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের বহরে সেবার প্রথমবারের মতো আসে ২০০০ সিরিজের ডিজেলচালিত জিএম বি১২ মডেলের ইঞ্জিন। আর সর্বশেষ ২০২০ সালে কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয় ৩০০০ হাজার সিরিজের ইঞ্জিন যুক্ত হয় চট্টগ্রামে। মূলত এসব কোরিয়ান ইঞ্জিনই বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেন চালানোর ভরসা।

অথচ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, একটি ইঞ্জিনের ইকোনমিক লাইফ বা কার্যক্ষমতা থাকে ২০ বছর। সেই হিসেবে চট্টগ্রামের প্রায় ৬৭ শতাংশ ইঞ্জিন কার্যক্ষমতা হারিয়েছে।

চট্টগ্রামে বর্তমানে ২০০০ সিরিজের ২টি, ২২০০ সিরিজের ৪টি, ২৬০০ সিরিজের সচল ৮টি, ২৭০০ সিরিজের ৬টি, ২৯০০ সিরিজের ১৫টি এবং ৩০০০ সিরিজের ১৭টি ইঞ্জিন সচল আছে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫৩, ১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয়েছিল ২০০০ সিরিজের মিটার-গেজ ডিজেল-বৈদ্যুতিক ৪০টি ইঞ্জিন। ৭১ বছরের পুরনো এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৬টি এখনও ব্যবহার হয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে। তবে এগুলোর মধ্যে ২টি কেবল ট্রেন শান্টিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়। বাকি ৪টি পড়ে আছে পাহাড়তলী রেলওয়ে লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে।

১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয়েছিল ২২০০ সিরিজের ৪১টি ইঞ্জিন। চট্টগ্রাম বিভাগে এই সিরিজের ১১টি ইঞ্জিন দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৪টি। অন্যগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে ওয়ার্কশপে। আর এসব ইঞ্জিনের মেরামতে রেলওয়ে গচ্ছা দিচ্ছে কোটি টাকা। ৬৩ বছরের এই পুরোনো ইঞ্জিন গুলো দিয়ে এখন ট্রেন শান্টিং করা হয়।

২০০০ ও ২২০০ সিরিজে এসব ইঞ্জিনের ব্রেক পাওয়ার খুবই দুর্বল ও ব্রেক সিলিন্ডার নষ্ট। ডেটম্যান ফুড প্যাডেল (যা প্রতি ১ মিনিট পর পর চাপলে ট্রেন সচল থাকে) নষ্ট। ফলে চালক ১ মিনিট অমনোযোগী হলেই মাঝেপথে দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেন৷ দরজার রাবার সিল, গ্লাস উইপার নষ্ট ও জানালার গ্লাসও ভাঙা। এতে ধুলোবালি ও বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়লে ট্রেন চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

এরপর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয়েছিল ২৬০০ সিরিজের মিটার-গেজ ডিজেল-বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগে এই সিরিজের ১৬টি ইঞ্জিন থাকলেও ৮টিই অকেজো।

১৯৯৪ সালে কোরিয়ার তৈরি ২৭০০ সিরিজের মিটার-গেজ ডিজেল বৈদ্যুতিক ২১টি ইঞ্জিন বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগে বর্তমানে এই সিরিজের ১৮টি ইঞ্জিন থাকলেও সচল মাত্র ৬টি। একসময় এই সিরিজের ইঞ্জিন আন্তঃনগর ট্রেনে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে মেইল-কমিউটার ও লোকাল ট্রেনে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মালবাহী ট্রেনেও মাঝেমধ্যে ব্যবহার করা হয়। অধিকাংশ ইঞ্জিনের লুক আউট গ্লাস ঘোলা। এতে চালকের সামনে দেখতে অসুবিধা হয়।

১৯৯৯ সালে কোরিয়ার তৈরি ৩৯টি মিটার-গেজ ডিজেল-বৈদ্যুতিক ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন বাংলাদেশ রেলওয়ে বহরে যুক্ত হয়। চট্টগ্রামে এই সিরিজের ইঞ্জিন ২৪টি ইঞ্জিনের মধ্যে সচল রয়েছে ১৫টি। এসব ইঞ্জিন আন্তঃনগর ট্রেনে ব্যবহার করা হয়।

সর্বশেষ ২০২০ সালে কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয় ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগ পায় ২২টি। মূলত এই সিরিজের ইঞ্জিনই আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের মূল ভরসা। তবে এসব ইঞ্জিনেও রয়েছে পথে বিকল হওয়া ও আগুন ধরায় নজির। বর্তমানে ১৫টি ইঞ্জিন সচল আছে চট্টগ্রামে। অধিকাংশ ইঞ্জিনের আবার এসি নষ্ট। ৪টি ট্রাকশন মোটরের ২টিই নষ্ট। এতে জ্বালানি খরচও বেড়ে গেছে।

রেলওয়ে সূত্রে আরও জানা গেছে, ইঞ্জিন সংকটের কারণে নতুন ট্রেন চলাচল শুরু করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, মহানগর গোধুলি, মহানগর প্রভাতী ও তূর্ণা নিশিথা নামে আন্তঃনগর ৬টি ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া কর্ণফুলী এক্সপ্রেস নামের একটি মেইল ট্রেনও চলাচল করে।

এরমধ্যে সূবর্ণ এক্সপ্রেস ও সোনার বাংলা ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশন ছাড়া কোথাও যাত্রা বিরতি দেয় না। কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারায় চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায়ও শীর্ষে এই দুটি ট্রেন। ফলে এই দুটি ট্রেনের টিকিট নিয়ে বেশি কাড়াকাড়ি ও কালোবাজারি হয়। এই রুটে কমপক্ষে আরও ৫টি আন্তঃনগর ট্রেনের চাহিদা থাকলেও ইঞ্জিন সংকট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া ঢাকা-কক্সবাজার রুটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটক এক্সপ্রেস নামে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু রয়েছে। এছাড়া ১টি কক্সবাজার স্পেশাল নামের একটি লোকাল ট্রেনও আগামী ২০ মে পর্যন্ত চলাচল করবে। চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটে একটি তেলাবাহী ট্রেন চলাচল করে। তবে পটিয়া ও দোহাজারী পর্যন্ত দুটি ট্রেন চলাচলের রুটিন থাকলেও ইঞ্জিন সংকটের কারণে তা বন্ধ রয়েছে। অথচ ৯০ দশকে এই রুটে ৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করলেও এখন কোনো লোকাল ট্রেন চলাচল করে না৷

একইসঙ্গে চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও উদয়ন এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন চালু থাকলেও জালালাবাদ নামের একটি মেইল ট্রেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটে বিজয় এক্সপ্রেস ও ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস নামে দুটি, চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে মেঘনা, সাগরিকা নামে ২টি মেইল ট্রেন চলাচল করে৷ তবে চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটে আরও ২টি, সিলেট রুটে ৩টি ও চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে ২ টি ট্রেন চালু করতে বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়েছে সাধারণ মানুষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটে শাটল ও নাজিরহাট রুটে ১টি লোকাল, ১টি ডেমু ও ১টি তেল বহনকারী ট্রেন (পিডিবি) চলাচল করে। চবি শিক্ষার্থী ও উত্তর চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি, নতুন করে ৫টি শাটল ও নাজিরহাট রুটে ৫টি লোকাল ট্রেন চালুর।

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট রুটে দৈনিক ৪-৫টি তেলবাহী ও মালবাহী কন্টেইনার ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ও পদ্মা, যমুনা শোধনাগারে থেকে রেলওয়ে বন্দরে তেল ও মালামাল আনা-নেওয়ায় ২২০০ সিরিজের ৩টি ইঞ্জিন ব্যবহার হয়। এসব রুটে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নতুন মালবাহী ট্রেন চালু সম্ভব হচ্ছে না।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ইঞ্জিন সংকট রয়েছে। এতে নিয়মিত ট্রেন চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তবে ইঞ্জিন কেনাকাটা আমাদের হাতে নেই। আমাদের যে ইঞ্জিনগুলো রয়েছে, সেগুলো মেরামত করেই অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করি। যে কোনো ঈদে চাপ আরও বাড়ে। ঈদুল আযহার জন্য ইতোমধ্যে ইঞ্জিনগুলো মেরামতের জন্য পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে বলা হয়েছে।’

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও ব্যবহার হচ্ছে। অধিকাংশ ইঞ্জিনের ব্রেক পাওয়ার খুবই দুর্বল ও ব্রেক সিলিন্ডার নষ্ট। ডেটম্যান ফুড প্যাডেল নষ্ট। দরজার রাবার সিল, গ্লাস উইপার নষ্ট ও গ্লাস ভাঙা। এতে ধুলোবালি ও বৃষ্টির পানি ঢুকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন কেনা ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনেও পথে বিকল হওয়া ও আগুন ধরার ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ইঞ্জিনের এসি নষ্ট, ইঞ্জিন রুমটিও ছোট। ৪টি ট্রাকশন মোটরের ২টি নষ্ট। এতে ইঞ্জিনের গতি কমে জ্বালানি খরচ বেড়েছে। চালকেরা ঝুঁকি নিয়ে, কষ্ট করে ট্রেন চালান।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘যাত্রী সুবিধার জন্য কোন বিষয়টি অগ্রধিকার ভিত্তিতে করা দরকার, তা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নলেজে নেই। এজন্য কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও ইঞ্জিন সংকট দূরীকরণে কোনো পদক্ষেপ নেই।’

তিনি বলেন, ‘৭১ বছরের পুরোনো ইঞ্জিন এখনও ব্যবহার হচ্ছে। যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনা করে নতুন লোকাল ও আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা জরুরি। আর নতুন ট্রেন চালুর জন্য দরকার ইঞ্জিন আমদানি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm