ইউরোপের মায়ায় চট্টগ্রামের যুবক ক্রোয়েশিয়ার জঙ্গলে, অকথ্য নির্যাতনের কাহিনী

মানবপাচারে আইআইইউসির কথিত শিক্ষক ও তার ভাইয়ের চক্র

আলফাই আল হোসাইন, থাকেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। উন্নত জীবন ও টাকা আয় করে পরিবারের হাল ধরবেন—এই আশাতেই বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ায়। বিদেশে ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখা হোসাইনের এ বাবদ খরচ হয় সাড়ে আট লাখ টাকা। কিন্তু স্বপ্ন সত্যি হয়নি, বেশি বেতনে রেস্টুরেন্টে চাকরির কথা বলে পাঠানো হলেও হোসাইন পড়েন মানবপাচারকারীর খপ্পরে। মানবপাচারকারীদের কাছ থেকে হোসাইনকে কিনে নিয়ে বিনামূল্যে জঙ্গলে গাছ কাটার চাকরি দেন ক্রোয়েশিয়ার এক নাগরিক। বেতনের বিনিময়ে তার কপালে জোটে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। পরে জাতিসংঘের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন হোসাইন। ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের মো. তাজুল ইসলামের ছেলে।

শুধু হোসাইন নন, কয়েক হাজার বাংলাদেশির সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় অভিবাসন বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা।

অভিবাসন সংস্থাগুলো জানায়, ইউরোপের দেশগুলোতে পাচারের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বরে। উন্নত জীবনের লোভে পড়ে এ পর্যন্ত ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন প্রায় ৬২ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক। যাদের অধিকাংশই হয়েছেন মানবপাচারের শিকার। এর মধ্যে কারো কারো হয়েছে সলিল সমাধিও। আর যারা সকল বাধা পার হতে পেরেছেন তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাটাচ্ছেন মানবেতর জীবন।

জানা গেছে, ইউরোপের দেশগুলোতে ঢুকতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সাগরে ডুবে মারা গেছেন ২১ হাজার ৭০৭ জন। এত ঝুঁকির মধ্যে দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হন তারা।

২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে মানবপাচারে ৫ হাজার ৭৩৮টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৮২টি মামলা। শুধুমাত্র ২০২০-২০২১ সালেই মামলা হয়েছে ৭০৭টি।

ইউরোপের দেশগুলোতে ঢুকতে বাংলাদেশি দালালরা ১৮টি রুট ব্যবহার করে। এরমধ্যে বেশিরভাগ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারত-তুরস্ক-সুদান-লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। আবার বাংলাদেশ থেকে দুবাই লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ট্যুরিস্ট ভিসার বৈধতা দেওয়ায় দুবাই দিয়ে মানবপাচারের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্যমতে, দুই বছরে প্রায় ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬৪ জন বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই গেছে। এরমধ্যে দেশে ফেরত এসেছে মাত্র ২১ হাজার ৭৫৪ জন। বাকি ১ লাখ ৭৮ হাজার ১১০ জনের খবর জানা নেই।

পুলিশের মানবপাচার দমন ইউনিট জানায়, দেশে মানবপাচারে সক্রিয় রয়েছে ৪০ হাজার দালাল। যারা বিভিন্নভাবে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক স্বল্প আয়ের লোকদের টার্গেট করে। এ পর্যন্ত মানবপাচারে জড়িত ২৪ হাজার ৫০০ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও এরমধ্যে বিভিন্ন সময় আটক হয়েছেন মাত্র ১০ হাজার ৫০০ জন। তবে এদের মধ্যে শুধুমাত্র ৭১ জন পাচারকারীর শাস্তি হয়েছে।

আলফাই আল হোসাইন বলেন, ‘আমাকেও দালালরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেন, বিনিময়ে আরও আড়াই লাখ টাকা দিতে হবে তাদের। সেই চুক্তিতে সাড়া না দেওয়ায় আমাকে মারধরও করে তারা।’

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের আদমব্যাপারি মো. কামরুল হাসান চৌধুরী ও তার ভাই মো. মঈনউদ্দীন হাসান চৌধুরীর মাধ্যমে সাড়ে আট লাখ টাকায় আমি ক্রোয়েশিয়া আসার চুক্তি করি। এর মধ্যে মঈনউদ্দীন নিজেকে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ফ্যাকাল্টির শিক্ষক বলেও পরিচয় দেন। তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে আমি ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে ক্রোয়েশিয়া পৌঁছাই ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর আগে দালালরা আমাকে ভারতে নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার ভিসা করিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়া পৌঁছানোর পর সেখানকার দালালরা আমার পাসপোর্ট নিয়ে আরও বেশি টাকা দাবি করতে থাকে। আমি দিতে না চাইলে আমাকে ক্রোয়েশিয়ার এক নাগরিকের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। আমাকে রেস্টুরেন্টে চাকরি দেওয়ার কথা থাকলেও দেয় জঙ্গলে গাছ কাটার চাকরি, তাও বেতন ছাড়া। আমি এসব বিষয় কামরুল ও মঈনকে জানালে তারা কোনো ধরনের সাহায্য করেনি। এক পর্যায়ে আমি দেশে চলে আসার কথা বললে ক্রোয়েশিয়ার দালাল ডেভিড ও ভিকি আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এরপর আমি অনেক কষ্টে জাতিসংঘের মাধ্যমে ২০২০ সালের ১২ মে দেশে ফিরে আসি।’

দেশে ফিরে কামরুল হাসান চৌধুরী, মঈন উদ্দীন হাসান চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন মামুন, মো. জালাল উদ্দিন, মো সাইফুদ্দিন ইসলাম, মো. রাজিব, মো. ওয়াসিম এবং ক্রোয়েশিয়ার নাগরিক ডেভিড, ভিকি ও হাবিবের নামে মানবপাচার আইনে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেন হোসাইন। এ মামলায় ২০২০ সালের ২৭ মে প্রথম চার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তারা দেড় মাসের মধ্যে জামিনে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু যে ধারায় মামলা হয়েছে তাতে ছয় মাসের আগে জামিন দেওয়ার নিয়ম নেয় বলে জানা গেছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ‘দেশে মানবপাচারের অপরাধে জড়িতদের শাস্তি হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। ফলে মানুষ মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ছে বেশি। শাস্তি না হওয়ায় তাদের ভয়ও কম।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm