আ জ ম নাছির যে কারণে মনোনয়ন পেলেন না

জল্পনা-কল্পনার ডালপালা মাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে কপাল পুড়লো বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের।

গত কিছুদিন ধরেই প্রায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, মেয়র পদে আ জ ম নাছির উদ্দীনের ওপর আর আস্থা রাখছেন না প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যেসব কারণে নাছির পিছিয়ে যাচ্ছিলেন নাছির— তা নিয়েও আলোচনা চলছিল বিভিন্ন মহলে।

শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও মনোনয়ন দৌড়ে নাছিরের যেসব কারণে পিছিয়ে পড়েন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের দল ও সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র, মোটা দাগে এই কারণগুলো হচ্ছে—

প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা
জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান দায়িত্ব বলে গত নির্বাচনী বৈতরণী পার হলেও সেই কাজে কোন ভূমিকা রাখতে পারেননি নাছির। বরং জলাবদ্ধতার বিষয়ে কাজ করার নিয়ন্ত্রণ খুইয়েছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে। চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বাদ দিয়ে সিডিএকে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মেগা প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। নিজের নির্বাচনী প্রধান অঙ্গীকারের বিষয়ে কাজ করার ক্ষমতা হারানোকে মেয়রের একটি বড় ব্যর্থতা বলেই মনে করছেন চট্টগ্রামের ভোটাররা।

এক ব্যক্তি এক পদ
একই ব্যক্তিকে দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে না রাখার বিষয়ে আওয়ামী লীগের মানসিকতা আ জ ম নাছিরের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে ছিল বড় একটি বাধা। সেক্ষেত্রে সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য নাছিরকে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে এনে মেয়র পদে নতুন কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলেন কেউ কেউ।

দলে দূরত্ব ও স্নায়ু দ্বন্দ্ব
নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব ও স্নায়ু দ্বন্দ্ব এবং সিনিয়র নেতাদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ। দীর্ঘদিন নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে আ জ ম নাছিরের বিরোধ বেশ আলোচিত ছিল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের সাথে স্নায়ু-দ্বন্দ্ব তৈরি হয় মেয়র নাছিরের। সর্বশেষ একটি অনুষ্ঠানে মহিউদ্দিন-পত্নী হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চ থেকে অশোভনভাবে নামিয়ে দেওয়ার বিতর্ক সেই স্নায়ুযুদ্ধকে অনেকটা প্রকাশ্য রূপ দিয়েছে।

সৌন্দর্যবর্ধনের বাণিজ্য
‘সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের’ নামে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ফুটপাত দখল করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ ছিল ব্যাপকভাবে। নগরজুড়ে এ নিয়ে নাগরিকদের সীমাহীন বিরক্তি ও অসন্তোষ।

বিশৃঙ্খল সিটি করপোরেশন
গত ৫ বছরে সিটি করপোরেশনে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ এবং দুদকের নজরদারি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগও আলোচনায় আছে বেশ শক্তভাবে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচনায় নিতে পারেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এমন আশংকাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।

দায়িত্বের ভারে মূল দায়িত্বে অবহেলা
মেয়র ও দলের শীর্ষ পদে থেকেও অন্তত অর্ধশতাধিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দরসহ ব্যক্তিগত কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকায় সিটি করপোরেশনের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে মনে করেন অনেকেই। এই দীর্ঘ সময়ে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সহ-সভাপতিসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের দায়িত্বেও ছিলেন মেয়র নাছির। এক সাথে এতসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সিটি কর্পোরেশন মেয়রের মূল দায়িত্বে বলার মত সফলতা দেখাতে পারেননি তিনি— এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।

মেয়াদজুড়ে অনাস্থা
মেয়াদের পুরো ৫ বছরেই ‘অতিরিক্ত সচিব’ পদমর্যাদায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রামের সিটি মেয়র নাছির উদ্দিন। চট্টগ্রামের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ সিটির মেয়রদেরকেও প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হলেও আ জ ম নাছিরের মুকুট ছিল শূন্য। ঢাকার পরেই গুরুত্ব বিবেচনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অবস্থান হলেও মেয়র আ জ ম নাছিরউদ্দিনকে ধারাবাহিকভাবে পদমর্যাদার বাইরে রেখে দেওয়ার বিষয়টিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি তার ওপর নেই। এ কারণে গত অন্তত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামভিত্তিক উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর প্রায় সবই সিটি কর্পোরেশনকে না দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে।

সড়কের দুরবস্থা
দায়িত্ব পালনকালে চট্টগ্রাম নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নির্মাণকাজে দীর্ঘসূত্রতা ও এসব কাজ শেষ করতে না পারার ব্যর্থতাও ডোবাতে পারে মেয়র নাছিরকে। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান দুটি সড়ক পোর্ট কানেকটিং রোড ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। ২০১৭ সালের শেষের দিকে এই দুটি সড়কের কাজ শুরু করে চসিক। ২০১৯ সালের মে মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এই দুই সড়কের বেশিরভাগ কাজই অসম্পন্ন। নির্বাচনের আগে এই দুটি সড়কের নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে আরাকান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে মোহরা অংশেও। প্রায় সাড়ে তিন বছর টানা ভোগান্তির পর গত বছরের জুলাই থেকে এই সড়কের সংস্কার কাজ শুরু করে চসিক। তবে সেই সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হয়নি এখনো। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। ২০১৭ সালের ১২ মার্চ চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শুধু চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সড়কের অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ নগরীর এ দুরবস্থা আমি দেখতে চাই না। কার গাফিলতিতে এ দুরবস্থা তা জানতে চাই। আপনারা ডিপিপি প্রণয়ন করুন। একনেকে পাঠান, একনেকে তো আমি সভাপতিত্ব করি, আমি অনুমোদন দেব। কিন্তু কাজ হবে না তা সহ্য করব না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm