আর ‘মাই ম্যান’ কমিটি বিলাতে পারবে না চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ, কড়া বার্তা কেন্দ্রের

১ বছরে ২০টি ইউনিট কমিটি, সবই ইমু-দস্তগীরের ইচ্ছায়

সম্মেলন ছাড়া আর কোনো ইউনিটের কমিটি করতে পারবে না চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। এই নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের বাদ দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের ‘মাই ম্যান’ দিয়ে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে কমিটি করার বিতর্কের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত দিল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী। প্রদীপ চৌধুরীসহ নগর ছাত্রলীগের তিন নেতা সাংগঠনিক সফরে চট্টগ্রাম আসেন। এই নেতাদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি শওকত হোসেন ছাড়াও সহ-সম্পাদক পদমর্যাদার এক নেতা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তত ২০টি ইউনিট কমিটি অনুমোদন দিয়েছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ। তবে এর কোথাও সম্মেলন করে কমিটি অনুমোদন দিতে পারেনি তারা। এর মধ্যে অনেক ইউনিটে এসব কমিটিকে ‘মাই ম্যান’ কমিটি অভিহিত করে পাল্টা কমিটি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সেসব প্রতিবাদ আমলে না নিয়ে উল্টাপাল্টা কমিটি দেওয়া নেতাদের বহিষ্কার করেই সমাধান খুঁজেছে তখন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হালিশহর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে একই কায়দায় ছাত্রলীগের কমিটি অনুমোদনকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর দৃশ্যত খানিকটা ভিন্নপথে হাঁটছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

নগর ছাত্রলীগে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আছে— এমন মন্তব্য করে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আছে। বিশৃঙ্খলার কিছু তথ্য আমাদের কাছে ছিল, সেগুলো আমরা জানতে চেয়েছি। সে বিষয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।’

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কেন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি কী— চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তাদেরকে (নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) সেটা জিজ্ঞেস করেছি। বলেছি, এরপরে যদি কোনো ওয়ার্ড, থানা বা কলেজ ইউনিটে তারা কমিটি করতে চায় সেসব জায়গায় সম্মেলন করে যেন কমিটি দেয়। ইউনিটগুলোতে সম্মেলন করে কমিটি দেওয়ার বিষয়ে তাদের আমরা সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছি।’

নগর ছাত্রলীগের এই কমিটিকে ‘দীর্ঘদিনের কমিটি’ হিসেবে মন্তব্য করে নগর ছাত্রলীগের রাজনীতিকে আরও বেগবান করতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলবেন জানিয়ে প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘দেখেন এই কমিটিটা দীর্ঘদিনের কমিটি। এমনিতেই এখানে একটা শক্তিশালী সংগঠন আছে। তবু এটাকে কিভাবে আরও বেগবান করা যায়—এটা নিয়ে আমরা কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলবো। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের যারা নেতৃত্বে আছেন, আমরা উনাদের সাথেও কথা বলেছি। আশা করি এই সংগঠনকে আরও বেগবান করা যায় সে বিষয়ে আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নগর ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সুষ্পষ্টভাবে বলেছি এটা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পবিত্র আমানত। এই ছাত্রলীগে কোন প্রকার বিতর্কিতদের কোন স্থান নাই। যাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রে তাদের যেকোন ধরনের সহযোগিতার দরকার হলে সেটাও আমরা দেবো।’

প্রসঙ্গত, গত ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হঠাৎ করেই নগর ছাত্রলীগের অধীন ১৩ ইউনিটের আহ্বায়ক ও আংশিক কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়।

ওই সময় এসব কমিটিকে ‘মাই ম্যান’ কমিটি আখ্যা দিয়ে কয়েকটি ইউনিটে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিথুন মল্লিক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল। দুজনই নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ‘দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের’ অভিযোগে ১৭ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

এরপর ৩১ ডিসেম্বর আচমকা উত্তর হালিশহর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ও সদরঘাট থানা ছাত্রলীগের কমিটি দিয়ে বিপাকে পড়ে নগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ইমু ও সাধারণ সম্পাদক দস্তগীর।

এই কমিটি ঘোষণার পরপরই রাস্তা অবরোধ করে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। তারা ইমু-দস্তগীরকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেন। কমিটি ঘোষণার দুই দিন পরেই নগর ছাত্রলীগের পদধারী ১১ নেতার স্বাক্ষরে ঘোষিত হয় ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি। এবারে পাল্টা কমিটি অনুমোদন দেওয়া ১১ জনই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।

গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনেই ইমু-দস্তগীরের স্বাক্ষরে মোহাম্মদ রাশেদকে সহ-সম্পাদক ও এসএম বিশালকে সদস্য পদে মনোনীত করা হয় আচমকা। নগর ছাত্রলীগের হঠাৎ এই সদস্য সংযুক্তির বিষয়টিকে ‘অবৈধ ও গঠনতন্ত্রবিরোধী’ বলে মতপ্রকাশ করেছেন একাধিক ছাত্রনেতা। তারা এও বলছেন, যেখানে খোদ ইমু-দস্তগীর কমিটিরই মেয়াদ নেই, সেখানে নতুন করে সদস্য সংযুক্তিই রীতিমত হাস্যকর।

নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘নতুন সদস্য সংযুক্তির কোনো এখতিয়ার নগর ছাত্রলীগের নেই। এটা সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্রবিরোধী। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের কোনো ধারাতে কোনো ইউনিটকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তারা দেখাক, গঠনতন্ত্রের কোন্ ধারা অনুযায়ী তারা নতুন সদস্য সংযুক্তি করেছে।’

নগর ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, নীতি আদর্শ তো বাদ, কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে মহিউদ্দিন গ্রুপ, নাছির গ্রুপের সমীকরণও মানছেন না ইমু-দস্তগীর। নিজেদের নিজস্ব লোক ছাড়া কাউকেই নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিতে রাজি নন এই দুই নেতা।

লাগামছাড়া চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগকে বশে আনতে দেরিতে হলেও এবার কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!