আয়কর-ভ্যাট নিয়ে ভোগান্তিতে চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা, অনেকে করছেন পেশা বদল

আয়কর ফাইল অডিটের নামে চলে হয়রানি

চট্টগ্রামে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ও আয়কর নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। নিয়মিত ভ্যাট দেওয়ার পরও অনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। প্রতিবছর আয়কর দিলেও ফাইল অডিটের নামেও নানান হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।

চট্টগ্রামের জুয়েলারি সমিতির নেতাদের দাবি, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা দ্রুত সময়ে আইনি সহায়তা পান না। স্বর্ণ বহনের সময় নিরাপত্তাহীনতায়ও থাকেন। এসব কারণে অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী করোনার পর থেকে পেশাতে টিকতে না পেরে করেছেন পেশা বদল। একইসঙ্গে ভ্যাট ও আয়করের বিষয়টি যদি সহজ করা হয় তাহলে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়বে। তাই ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশে আনলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) চট্টগ্রাম জেলা শাখা জানায়, চট্টগ্রামে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন। এসব ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় সবাই নিয়মিত ৫ শতাংশ ভ্যাট ও আয়ের ওপর কর পরিশোধ করেন। কিন্তু এরপরও ভ্যাটের লোকজন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় করে। একইসঙ্গে আয়কর ফাইলগুলো অডিটে ফেলেও হয়রানি করা হয়।

জানা গেছে , বাংলাদেশের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ ১৪ দশমিক ৩০ টন। কিন্তু দেশের বিমানবন্দরগুলোতে প্রায় সময় স্বর্ণ নিয়ে ধরা পড়ে চোরাচালান চক্রের সদস্যরা। কিন্তু এসব চোরাচালানকারীদের কোনো বিচার হয় না। গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার পরও চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এসব স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। এতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এদিকে গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রামে জেলায় প্রায় শতাধিক স্বর্ণের দোকান চুরি হয়েছে। এসব ব্যবসায়ীদের অনেকে তাদের হারানো স্বর্ণ ফেরত পাননি। বছরে অসংখ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী হামলার শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে চুরি হওয়া স্বর্ণ বন্ধক বা ক্রয়ের অভিযোগ পেলে নানান রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে হয়রানি করে পুলিশ। অনেক ব্যবসায়ী প্রতারক চক্রের খপ্পড়েও পড়েন। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো সুষ্ঠু বিচার পান না তারা।

সম্প্রতি প্রতারণার শিকার হন চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড থানার মাদ্রাজী শাহ্ রোডের স্বর্ণ ব্যবসায়ী পলাশ কান্তি দাশ। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে একজন কাস্টমার ১ ভরি স্বর্ণ ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে বন্ধক রেখেছিলেন। পরে স্বর্ণগুলো যাছাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখি, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। মূলত বন্ধকি স্বর্ণগুলোর ওপরের প্রলেপ ছিলো স্বর্ণের কিন্তু ভেতরে সব তামা। এই স্বর্ণ গলিয়ে আমি সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পাবো। কিন্তু বাকি ৩০ হাজার টাকা আমার লোকসান।’

Yakub Group

নগরীর কদমতলী এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী রতন ধর বলেন, ‘আমরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলের কারণে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছি। কোরবানি ঈদের সময় একজন কাস্টমার এসেছিল আমার দোকানে স্বর্ণ বিক্রির জন্য। তার মা হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন। আমি স্বর্ণগুলো কেনার জন্য ক্যাশ মেমো চাইলে তিনি বলেন, তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেলে এসেছি, কাল পরশুর মধ্যে দিয়ে যাব। পরে আমার দোকানে চুরি যাওয়া স্বর্ণের খোঁজে পুলিশের তল্লাশি চালায়। পরে জানতে পারি চুরি যাওয়া এই স্বর্ণগুলো দুই-তিন হাত বদল হয়ে আমার দোকানে আনা হয়েছে। হয়রানির কথা নতুন করে কি আর বলবো।’

এছাড়া গত ২৩ জুন কক্সবাজারের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিনতাইয়ের শিকার হন। তার কাছ থেকে নগদ ১১ লাখ টাকা ও ২০ ভরি স্বর্ণ ছিনতাই হয় সেদিন। তবে ১৬ ভরি স্বর্ণ ও ১ লাখ টাকাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যা ব।

এদিকে করোনা পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক মন্দা, ভ্যাটের হয়রানি থেকে শুরু করে নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন স্বর্ণ ব্যবসা। এই রকমই একজন রাজিব ধর। ইপিজেড এলাকার নারিকেল তলা হক সাহেবের গলিতে তার ‘জয় জুয়েলার্স’ নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে দোকান বন্ধ করে দেন। পরে তিনি দেশের বাইরে চলে যান।

রাজিবের মতো একই পরিণতি হয়েছিল স্থানীয় আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী তপন ধরের। করোনা পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় মন্দার কারণে তিনিও ছেড়ে দেন এই ব্যবসা। এখন তিনি একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রণব সাহা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমস্যা ও হয়রানির বিষয়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেছি। আশা করি, সমস্যার সমাধান হবে। বর্তমানে চট্টগ্রামে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী রয়েছে। তবে ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে।’

বাজুস চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মৃণাল ধর বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভ্যাট ও ট্যাক্স নিয়ে। আমরা যারা নিয়মিত ভ্যাট ও ট্যাক্স দিচ্ছি বার বার তাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে। সামনে আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে এসব বিষয়ে জানাবো।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘গ্রামের চেয়ে শহরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা অনেক নিরাপদ। যদি কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী হয়রানির শিকার হন এবং অভিযোগ দেন তাহলে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখবো।’

আয়কর ফাইল অডিট ফেলা ও হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের একটি কর অঞ্চলের ঊর্ধ্বতন কর কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ব্যাপারে স্বর্ণ ব্যবসায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!