আফ্রিকার দেশে বাঁশখালীর লোক মারা যাচ্ছেন একের পর এক

করোনায় মৃত ১৪ বাংলাদেশির ১০ জনই বাঁশখালীর

আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আফ্রিকার ৫৪টি দেশে এখন পর্যন্ত ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে লিবিয়ার পরেই করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মোজাম্বিকে। দেশটিতে নতুন করে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৩৮০ জন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করছেন— যাদের বেশিরভাগই সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।

গত ছয় মাস ধরে বিস্ময়কর পূর্ব আফ্রিকার দেশ এই মোজাম্বিকে করোনায় একের পর এক মারা যাচ্ছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর লোক। গত ছয় মাসে দেশটিতে ১৪ জন প্রবাসী বাংলাদেশি মারা যান। এর মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার অধিবাসীই অন্তত ১০ জন— যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আফ্রিকার দেশটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের কারোরই লাশ আর দেশে আনা যায়নি করোনা মহামারীর কারণে।

প্রবাসের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, মোজাম্বিকসহ আফ্রিকার দেশগুলোতে বর্তমানে শত শত বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। অনেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে ঘরবন্দি হয়ে থাকছেন।

প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বাঁশখালীর আব্দুল্লাহ মামুন (৩৬)। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মোজাম্বিকের মানিকা প্রদেশের স্থানীয় একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। আব্দুল্লাহ মামুন ওই প্রদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। তার বাড়ি বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ২০০৭ সালে জীবিকার তাগিদে মোজাম্বিকে পাড়ি জমান তিনি। পরিবারসহ মোজাম্বিকেই বসবাস করতেন। তার এক মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান রয়েছে।

সবশেষ শনিবার (২৪ জুলাই) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাহমুদুল ইসলাম (৪২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে মোজাম্বিকে। মাহমুদুলের বাড়িও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিম চাম্বলের ১ নম্বর ওয়ার্ড জয়নগর এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মৃত আজিজ আহমদের ছেলে। মোজাম্বিকের ইয়ানবাহনি প্রদেশের ইয়ানসুরু শহরে গত নয় বছর ধরে ব্যবসা করে আসছিলেন মাহমুদুল ইসলাম। সেখানেই তিনি সপরিবারে থাকতেন স্ত্রীসহ দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে। তার বড় ভাই মোহাম্মদ বাদশাও মোজাম্বিকপ্রবাসী।

জানা গেছে, প্রায় ১০ দিন আগে হঠাৎ করে মাহমুদুলের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পর তাকে স্থানীয় ইয়ানবানি বিভাগীয় জানগামো কোভিন-১৯ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। এরপর শনিবার (২৪ জুলাই) বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। তাকে মোজাম্বিকেই দাফন করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) স্থানীয় সময় রাত ৯টায় মোজাম্বিকে করোনা আক্রান্ত হয়ে জুলফিকার আহমদ (৪৮) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নের পশ্চিম মনকিরচর নয়াঘোনায়। তিনি ওই এলাকার রওশন আলী তালুকদার বাড়ির মরহুম সিরাজুল হকের ছেলে। গ্রামের বাড়িতে তার স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তিনি গত সাত বছর ধরে মোজাম্বিকের সিমুই শহরে ব্যবসা করে আসছিলেন।

জানা গেছে, মোজাম্বিকের মানিকা প্রদেশের সিমুই সিটির ব্যবসায়ী জুলফিকার আহমদ প্রায় ১০ দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (২২ জুলাই) স্থানীয় সময় রাত ৯টায় তার মৃত্যু হয়। জানাজা শেষে মোজাম্বিকেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

গত ১৩ জুলাই মোজাম্বিকের সুফলা প্রদেশের মারিংগুতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মনির উদ্দিন (২৯) নামে এক প্রবাসী। তিনি বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সেইন্ন্যা পাড়ার মৃত আব্দুল করিমের ছেলে। কয়েক বছর ধরে তিনি মোজাম্বিকের ভেয়রা শহরে ব্যবসা করে আসছিলেন। আগামী বছরের জানুয়ারিতে তিনি দেশে এলে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। করোনায় আক্রান্ত হলে মনির উদ্দিন বাসায় করোনার প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে তাকে সুফলা প্রদেশের বেইরা সিটির ‘হসপিটাল দ্য মুলেরহ ২৪ দি জুলুহ’ নামে এক হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কয়েকদিন পর সেখানেই তিনি মারা যান।

গত ২৪ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মোজাম্বিকের বেইরা প্রভিন্সের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফরিদুল আলম (৪৫) নামে এক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। তার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার শীলকূপ ইউনিয়নে। মোজাম্বিকে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি।

গত ২১ জানুয়ারি মোজাম্বিকের ইয়ামভানি প্রভিন্সের মাবিলা শহরে মোহাম্মদ আলী (৫০) নামে এক ব্যবসায়ী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বৈলছড়ি ইউনিয়ন ৬নং ওয়ার্ড। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির সাবেক সৈনিক মোহাম্মদ আলী প্রায় সপ্তাহখানেকের জ্বর-সর্দি নিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে ২১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তিনি মোজাম্বিকে বসবাস করে আসছিলেন।

চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মোজাম্বিকের সোফালা প্রভিন্সের মুসুংগু ডিস্ট্রিকের ব্যবসায়ী খোরশেদ চৌধুরী (৪২) করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার বাড়ি বাঁশখালী পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডে। খোরশেদ আলম করোনা আক্রান্ত হলে তাকে সিমুই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে দুদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর তার অবস্থার অবনতি হলে ওইদিনই উন্নত চিকিৎসার জন্য সোফলা প্রভিন্সিয়ার সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু ঘটে।

চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি মোজাম্বিক কের মানিকা প্রদেশের সিমুইতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আব্দুল মালেক মানিক (৪০) নামে বাঁশখালীর এক ব্যক্তির মৃত্যু হয় নিজ বাসাতেই। তিনি বাঁশখালীর শিলকূপ ইউনিয়নের মনকিচর গ্রামের হাজী পাড়ার মরহুম আবদুল মতলবের ছেলে।

২২ জানুয়ারি মোজাম্বিকে মানিকা প্রদেশের সিমুইতে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান মোহাম্মদ হোসাইন (৩২)। তিনি বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের ৬০ নং পাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের পুত্র। হঠাৎ কাশি বেড়ে যাওয়ার একপর্যায়ে নিজ বাসাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। ২০১৪ সালে জীবিকার তাগিদে মোজাম্বিকে পাড়ি জমান তিনি।

দূরদেশে আরও মৃত্যু ও অপমৃত্যু

গত ২ জুলাই মোজাম্বিকের ক্যাব দেলগাদো প্রদেশের বালামা সিটি এলাকার মুদি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান নামপুলা সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়। প্রায় দুই বছর আগে তিনি মোজাম্বিকে পাড়ি জমান। তিনি তিন মেয়ে এক ছেলের জনক। তার বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নে।

গত ২৩ এপ্রিল মোহাম্মদ ছরোয়ার উদ্দিন (২৮) এবং ছাবের আহমদ (৩৫) নামে দুই বাংলাদেশির রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে মোজাম্বিকে। দেশটির জামবেজিয়া প্রদেশে মিলান্জি ডিসট্রিক্টের নুটুকো এলাকায় নিজেদের বাসায় তালাবদ্ধ অবস্থায় দুজনের লাশ পাওয়া যায়। ২০১৬ সাল থেকে তারা অংশীদারী ভিত্তিতে ব্যবসা করে আসছিলেন। এর মধ্যে ছরোয়ার উদ্দিন বাঁশখালী উপজেলায় সরল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বাদশা মিয়ার ছেলে। অন্যদিকে ছাবের আহমদও একই ওয়ার্ডের আব্দুল মাতলবের ছেলে।

গত বছরের ৫ নভেম্বর মোজাম্বিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রসমাজের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আতিকুর রহমান সিদ্দিকী দেশটির টেটে প্রভিন্স সেন্ট্রাল হাসপাতালে মারা যান। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও ডায়বেটিস রোগে ভুগছিলেন। আতিকুর রহমানের বাড়ি বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাদালিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম আহমদ কবির তালুকদার।

একই বছরের ৬ ডিসেম্বর মোজাম্বিকের জাম্বেজিয়া প্রদেশের মুলুভু জেলার মিসায়াস নামক স্থানে সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারান এক বাংলাদেশী যুবক। নিহত যুবক ফরিদুল আলমের (২৫) বাড়িও বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নের আহমদিয়া পাড়ায়।

অনলাইন অ্যাপ লাইকির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সম্পর্কের সূত্র ধরে চট্টগ্রামের হালিশহর ও পতেঙ্গার দুই তরুণী ফৌজিয়া আনোয়ার (২২) ও পার্লার ব্যবসায়ী ঐশী মির্জাকে বিকাশ ও ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ধার দেন মোজাম্বিকপ্রবাসী তরুণ মিজানুর রহমান নীল। কিন্তু পরে ওই টাকা ফেরত চাইলে দুই তরুণীই ঘোরাতে থাকেন তাকে। শেষপর্যন্ত চলতি বছরের ৩১ মার্চ বান্ধবী ঐশীকে লাইকিতে লাইভে রেখেই ইঁদুর মারার বিষ খান মিজান। তাকে উদ্ধার করে মোজাম্বিকের তেতে প্রদেশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হলেও ১০ মিনিটের মাথায় তার মৃত্যু হয়। মিজান বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব কাহারঘোনার হাজি সিদ্দিক আহমদের ছেলে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!