আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এলো চট্টগ্রাম প্রতিদিন ও প্রেসক্লাবে হামলার চিত্র
আইএফজের দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) তাদের দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২৪-২৫-এ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে। ‘বাংলাদেশ: গণতন্ত্র পুনর্গঠন’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ কার্যালয়ে হামলা-চেষ্টা এবং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার সময় ২০ সাংবাদিকের ওপর নারকীয় হামলার ঘটনার ওপর। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের প্রাচীন এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
চট্টগ্রামের ঘটনায় দেখা গেছে, প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালস লিমিটেড নামক একটি টেক্সটাইল কারখানার কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রায় তিন শতাধিক লোক ‘দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ পত্রিকার কার্যালয় অবরোধ করে। তাদের একমাত্র দাবি ছিল পত্রিকার প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মুছে ফেলা— যাতে তুলে ধরা হয়েছিল তাদের কারখানার অনিয়ম ও অসদাচরণের অন্ধকার দিকগুলো। উত্তেজনাপূর্ণ এই পরিস্থিতিতে দাঙ্গা পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতিখার প্রতিবাদলিপি প্রকাশের আশ্বাসের পরই কেবল তারা স্থান ত্যাগ করে। সম্পাদক ইফতিখারের মতে, এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা ছিল না, বরং একটি সুপরিকল্পিত ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা অন্তত ৪ দফা– ৫, ৬, ১২ ও ১৪ আগস্ট হামলা চালিয়ে প্রেস ক্লাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দেশীয় অস্ত্র, হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ফটকের তালা ভেঙে তারা বার বার ক্লাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। এরপর পুরো ক্লাব দখল করে নেওয়া হয়।
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একটি দল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে হামলা চালায় এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করে, যাতে অন্তত ২০ জন আহত হন।’
আইএফজে তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়েই ৭ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ধামরাইয়ের সাংবাদিক স্বপন কুমার ভদ্রকে তার বাসার বাইরে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় এবং জুলাই মাসের বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৪ সাংবাদিক প্রাণ হারান।
আইএফজের প্রতিবেদন যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশন (আইএফজে) হলো বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর বৃহত্তম গ্লোবাল ইউনিয়ন ফেডারেশন। এটি ১৪৬টি দেশের ১৮৭টি সংগঠনের মাধ্যমে ৬ লাখেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আইএফজে বর্তমানে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে সক্রিয়, যা সাংবাদিকদের জন্য বৈশ্বিক কণ্ঠস্বরের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আইএফজে জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে।
প্রতি বছর আইএফজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের অধিকার, পেশাগত নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাত্রা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে কোথায় কতজন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন, গ্রেফতার বা হয়রানির মুখে পড়েছেন, কিংবা কারা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে জীবন হারিয়েছেন—এসব তথ্য বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়।
এই প্রতিবেদন বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সূচকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। আইএফজে-র এই বার্ষিক প্রতিবেদন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংগঠনগুলোর নীতিনির্ধারণ ও পদক্ষেপ গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইএফজির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক চিত্র
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে বলা হয়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর হামলার ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগস্ট ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বিএনপি সমর্থকদের হামলায় ২০ সাংবাদিক আহত হন। ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে শারিয়তপুরে হাসপাতাল কর্মীরা ৪ সাংবাদিককে আক্রমণ করে এবং মার্চ ২০২৫ সালে নাটোর আদালত প্রাঙ্গণে একটি সাংবাদিক দলকে আক্রমণের শিকার হতে হয়।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে একাত্তর টিভির ৪ সাংবাদিককে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর অভিযোগে আটক রাখা হয়। তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করায় নাটোরের সাংবাদিক আবদুর রশিদকেও গ্রেফতার করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, ডিজিটাল স্পেসেও সাংবাদিকদের ওপর চাপ বেড়েছে। জুলাই ২০২৪ সালে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং সামাজিক মাধ্যম ব্লক করে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) এর অধীনে ৫,৮১৮টি মামলা দায়ের করা হয়। নতুন প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবাদিকরা বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের সাংবাদিকদের ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সাংবাদিক মুন্নী সাহার অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় এবং আদিবাসী সাংবাদিক জুয়েল মারাককে হামলা করে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে বলা হয়, মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর জবরদখল ও নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ৩৫টি টিভি চ্যানেলের অর্ধেকের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রেস ক্লাব দখল করা হয় এবং অন্তত ১০০ সাংবাদিককে তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক চাপও সাংবাদিকদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ৪৮% টিভি চ্যানেল বরখাস্তকৃত সাংবাদিকদের জন্য কোনো সমাপ্তি সুবিধা দেয়নি, ৭২% সাংবাদিক অতিরিক্ত সময় কাজ করার জন্য পারিশ্রমিক পাননি এবং দুটি টিভি স্টেশন ও একটি দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শতাধিক সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছেন।
আইএফজে রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার যে আশা জেগেছিল, তা পূরণ হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর হস্তক্ষেপ, ইসলামিস্ট গোষ্ঠীর হুমকি এবং নতুন আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়ার যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণকারী সকল কঠোর আইন পর্যালোচনা, মিডিয়া মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাংবাদিকদের বিশেষ সুরক্ষা প্রদান।
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টটি শেষ হয়েছে একটি আশাবাদী নোটে— বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে অবশ্যই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী গণমাধ্যমকে তার যথাযথ স্থান দিতে হবে। এজন্য সরকার, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভিতকে শক্তিশালী করবে এবং নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করবে।
পুরো রিপোর্ট পাওয়া যাবে এই লিংকে— https://samsn.ifj.org/SAPFR24-25/bangladesh/
সিপি