‘আত্মহননের’ মহড়ায় সংক্রমণ ঠেকানোর যুদ্ধ!

এক শরীর থেকে আরেক শরীরে ভ্রমণপ্রিয়াসী করোনাভাইরাস মারাত্মক ছোঁয়াচে। অদৃশ্য— কিন্তু শক্তিশালী। শক্তিমান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। চিকিৎসক-নার্স এই যুদ্ধের সামনের সারিতে। সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরামহীন প্রচেষ্টা।

লক্ষ্য একটাই, দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখা— ঘরে রাখা। তাহলেই পরাজিত হবে করোনাভাইরাস। জয়ী হবে মানুষ। করোনা হারলে জিতবে জীবন— এমন সহজ অঙ্ক মেলাতেই যাবতীয় মানবিক আয়োজন সরকারপক্ষের। এরই অংশ হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে দেশ বন্ধ। ‘লকডাউন’ অবস্থায় আছে দেশ। কদিন পরই পূর্ণ হবে ‘লকডাউন’ মাস।

এবার দেখা যাক, জনগণ কতোটা সচেতন হলো। অবশ্য কথাটি অন্যভাবে বলা যেতে পারে, জাতিগতভাবে আত্মহননের প্রস্তুতির মহড়া কতোটুকু সম্পন্ন হলো। এই আত্মহনন দুইভাবেই ‘সুসম্পন্ন’ করছে কিছু মানুষ!

প্রথমত, মানবিক আত্মহনন এবং দ্বিতীয়ত, জাতিগত আত্মহনন। দুটোর অর্থ অভিন্ন। মানবিকতা না থাকলে মানুষ হয় না। আর মানুষ না থাকলে জাতি হয় না। মানবিকতা ও মানুষ— দুটোকেই বিদায় জানানোর প্রাক প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে মানুষের ওই দলটি।

যেভাবে মানবিক আত্মহনন
শুরু করি, জন্ম উপজেলা সাতকানিয়া থেকে। পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নে দুভার্গ্যজনকভাবে কয়েকজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেন। শুরুতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ছবিসহ পরিচয় প্রকাশ করে সমবেদনা জ্ঞাপন করা হলো। এরপর একদল লোক হামলে পড়ল আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে। আক্রান্তরা তাদের ঘরে থাকতে পারবেন না। কারণ, তারা অস্পৃশ্য! বাধ্য হয়ে তাদের আসতে হলো আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর একজন চিকিৎসকের শরীরে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীরা এমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন, যাতে ওই চিকিৎসক ভয়ে-আতঙ্কে অসহায়ত্ব নিয়ে বাসা ছাড়তে বাধ্য হলেন। চিকিৎসক নিজ বাসায় আইসোলেশনে থাকতে পারলেন না, গেলেন আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে। অথচ তিনি করোনাযুদ্ধের সামনের সারির সৈনিক।

চট্টগ্রামের তৃতীয় ঘটনাটি আরও মর্মান্তিক। নগরীর এক বৃদ্ধ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য গেলেন ফৌজদারহাটস্থ করোনা চিকিৎসালয়ে। ভোররাতে তিনি মৃত্যুর দ্বারে উপনীত হলেন। কতর্ব্যরত চিকিৎসক রোগীর অন্তিম সময়ে ফোনে ডাকলেন স্বজনদের। কিন্তু অন্তিম সময়ে স্বজনরা কেউই বৃদ্ধের পাশে গেলেন না!

টাঙ্গাইলের সখীপুরের জঙ্গলে এক বৃদ্ধা মাকে সন্তানরা ফেলে গেল করোনার ভয়ে। সন্তানদের ধারণা ছিল মা করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। অতএব মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ! কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলেদের আন্দাজ সঠিক ছিল না বলে প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীতে বৃদ্ধার করোনা পরীক্ষার রিপোর্টে।

যাই হোক, বৃদ্ধার ছেলে, নিহত বৃদ্ধের স্বজন, করোনা আক্রান্ত ডাক্তার-যুবকদের প্রতিবেশীরা তো আর বোকা নন। তারা ‘মারাত্মক’ বুদ্ধিমান। নিজেদের জীবন রক্ষায় অন্যের জীবন হুমকির মুখে ফেলতে তারা পিছপা হবেন কেন?

ওপরের চারটি ঘটনায় মানবিক আত্মহননের খণ্ডচিত্র। ১৯৫২ এবং ১৯৭১ সালের বীর লড়াকুদের এই স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের একটি অংশের বুদ্ধি এতোটাই ‘মারাত্মক’ যে তারা ভুলতে বসেছে মানবিকতা। সবাই মিলে যেন মানবিকতাকে গঙ্গাজলে ভাসানোর আয়োজন করছে। এটাই মানবিক আত্মহনন। যা প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোথাও না কোথায় ঘটে চলেছে।

যেভাবে জাতিগত আত্মহননের আয়োজন
মনুষ্য সদৃশ দেহগড়ন থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। মনুষ্যত্ব-মানবিকতা থাকতে হয়। সেই মানবিক আত্মহননের পর তো আর মানুষ্যরূপীদের বেঁচে থাকার দরকার পড়ে না। তাই সম্মিলিত আত্মহননের সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা যেতে পারে। তাই তো, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, আর্মি-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের অনুরোধ-নির্দেশ উপেক্ষা করে অলি-গলিতে কিংবা বাজারে বীরদর্পে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অপ্রয়োজনকে জরুরি প্রয়োজন বানিয়ে দিব্যি দ্বিচক্রযান কিংবা চর্তুচক্রযান চালাচ্ছেন।

এ ধরনের কিছু মানুষকে ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মৃদু লাঠিচার্জ করে সরাতে পারে। কিন্তু যখন একজনের জানাজায় অংশ নিতে লাখো মানুষ সড়কে নেমে আসেন, তখন তাদের কী করা যেতে পারে? সেই চিত্রই দেখা গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

আত্মসচেতন না হয়ে আত্মহননের পথে কেউ হাঁটলে তাকে বাধা দেবে কে? আর ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি মিলে, দলবদ্ধ হলে আর দলে দলে হাজার-হাজার থেকে লাখো লোকের সমাগম হলে-তখন কী বলা যাবে? নিশ্চিত, এটি জাতির আত্ম অ-সচেতনতার কুফল।

একদিকে একদল মানুষ মারাত্মক সচেতন হয়ে করোনাআক্রান্তদের চিকিৎসায় কিংবা বাসায় থাকতে বাঁধা দিয়ে মানবিকতা বিসর্জন দিয়েছেন, বৃদ্ধ বাবার অন্তিম মুহূর্তে পাশে না থেকে, বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে মানবিকতার কফিনে শেষ পেরেক টুকেছেন। তারপর এই ‘মারাত্মক’ সচেতন মানুষগুলো তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন— ‘যাক, করোনা থেকে বাঁচা গেল!’ যেন করোনা আক্রান্তকে সরতে বাধ্য করে, হেনস্তা করে, বৃদ্ধের অন্তিম মুহূর্তে পাশে না থেকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেছেন যে, করোনা তাদের সংক্রমিত করবে না।

অন্যদিকে, আরেক দল হাজারে-হাজারে ঘর থেকে বের হয়ে জানাজায় অংশগ্রহণ করেছেন। তারাও কি করোনাভাইরাসের সঙ্গে অভিন্ন চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন যে, করোনাভাইরাস তাদের সংক্রমিত করবে না।

করোনা আক্রান্তদের হেনস্তা করা মানবিকতার আত্মহনন। আর জানাজা বা যে কোনো ধর্মীয় কিংবা সামাজিকতার নামে এই করোনাকালে বিপুল জনসমাগম জাতিগত আত্মহননের মহড়া। ভাবুন, মানবিক ও জাতিগত আত্মহননের পর কে জিতবে? করোনাভাইরাস নাকি জীবন?

অথচ, এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কথা ছিল জীবনের, মানবিকতার!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!