আতঙ্কের চকবাজারে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং, ‘রিমোট কন্ট্রোল’ টিনুর ডান হাত ইভানের হাতে
কথায় কথায় অস্ত্র-গোলাগুলি নিত্যদিনের বিষয়
সকালে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারে মানুষের ঘুম ভাঙে অজানা শঙ্কায়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ছোট-বড় ঘটনা ঘটে। মোবাইল কিংবা টাকা ছিনতাই এসব নিত্যদিনের ঘটনা। তবে হামলার শিকার, এমনকি আঘাতে রক্তাক্ত হলেও কেউ থানায় যেতে চায় না। কারণ থানা পুলিশের হয়রানির ভয় চকবাজারেই বেশি। এই থানায় নতুন ওসি যোগ দেওয়ার পর থেকে এই ভয় আরও বেড়েছে। অভিযোগ করে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হবে, এমন আশঙ্কায় থানার ধারেকাছেও পারতপক্ষে যান না ভুক্তভোগীরা— এমন কথা শোনালেন চকবাজার এলাকার বাসিন্দারাই।
এর কারণও আছে। স্থানীয়রা বলছেন, চকবাজার থানায় নতুন ওসি যোগ দেওয়ার পরই হঠাৎ বেড়ে গেছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। অভিযোগ রয়েছে, টিনু গ্রুপ নিয়ে ওসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ওসি রুহুল আমীন পাঁচলাইশ থানায় এসআই থাকার সময় থেকেই টিনুর সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। সেই থেকে টিনুকে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে। এরপর তিনি সদরঘাট হয়ে ডিবিতে যোগ দেন। গত বছর টিনুর গ্রেফতারের পর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে টিনুর অনুসারী সন্ত্রাসী অভিক দাশ ও গার্মেন্টস নবীকে গ্রেফতার করেন ওসি রুহুল আমীন (তৎকালীন ডিবি পরিদর্শক)। কিন্তু তাদের একদিন ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে পরে ‘সমঝোতা’য় ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল সে সময়।
চকবাজারে কথায় কথায় অস্ত্র দেখানো কিংবা গুলিবর্ষণ যেন তুচ্ছ বিষয়। টার্গেট ব্যক্তিকে ধরে এনে গোপন টর্চার সেলে নির্যাতনের ঘটনাও অহরহ। আবার অনেকের কাছ থেকে আদায় করা হয় নগদ টাকা। হোটেল রেস্টুরেন্টে খাবারের বিল চাইলেই চলে ভাঙচুর। চকবাজার এলাকায় গত কয়েক বছরে অন্তত ৪০ জন ছুরিকাঘাত ও গুরুতর জখম হয়েছে সন্ত্রাসীদের হাতে।
ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ইভান ও তার গ্রুপ
চকবাজার-পাঁচলাইশের ত্রাস সাদ্দাম হোসেন ইভান। কথিত যুবলীগ নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর মোস্তফা টিনু কারাগারে থাকায় তার হয়ে প্রায় সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এই ইভান ও তার গ্রুপ। ছিনতাই, মাদক সেবন ও বিক্রি, ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ এমন কোন অপরাধ নেই যেখানে জড়িত নয় এই গ্রুপ। ফুটপাতের দোকান, গাড়ির স্ট্যান্ড, কোচিং সেন্টার, গার্মেন্টস, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল ও নির্মাণাধীন ভবনে একচ্ছত্র চলছে চাঁদাবাজি। এমনকি চকবাজার এলাকার হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতেও তার লোকজন থেকেই সাপ্লাই নিতে বাধ্য করা হয়। এরকম এক ঘটনায় চকবাজার ফুলতলা এলাকায় ফুটপাতে মাত্র ৩০ টাকা চাঁদার জন্য দেলোয়ার হোসেন দিলু নামে এক ক্ষুদ্র ফল ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করেছিল ইভান গ্রুপের সদস্য এহসানুল হক ইমন ও হৃদয়।
গত ২৯ আগস্ট বিকেলে অলি খাঁ মসজিদের সামনে দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষের সময় অস্ত্র হাতে দেখা গেছে ইভান গ্রুপকে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অন্তত ৪-৫টি করে মামলা আছে চকবাজার ও পাঁচলাইশ থানায়। গতবছর পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার তৈরি করা কিশোর গ্যাংয়ের তালিকায় চকবাজার থানায় এক নম্বরে নাম আছে সাদ্দাম হোসেন ইভানের। তার হেফাজতে থাকা টিনুর বিশাল অস্ত্র ভাণ্ডারের উদ্ধারে র্যাব কিংবা পুলিশেরও তৎপর নেই।
ভয়ংকর কিশোর গ্যাং লিডার সাদ্দাম হোসেন ইভানের বিরুদ্ধে এক সেলুন ব্যবসায়ীকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় মামলা নং- ১৭(৭)১৭ দায়ের হয়েছিল। এ মামলায় তিনি কারাগারে যান। এছাড়াও আধিপত্য বিস্তার, হত্যা চেষ্টা ও ভয়াবহ হামলার ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলা (নং- ৪(৫)১৭ এবং ৭(৫)১৭) দায়ের হয়েছিল। চলতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি ইমাম উদ্দিন আলিফ নামে এক ছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে দুটি মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় চকবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছিল।
নাটের গুরু টিনুর চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য
পুলিশের তৈরি করা চট্টগ্রাম নগরের ৪৮ জন কিশোর গ্যাং গডফাদারের তালিকায় নাম আছে নূর মোস্তফা টিনুর। আর এসব কিশোর অপরাধীদের ব্যবহার করে তার মাসিক আয় ছিল অন্তত ৫০ লাখ টাকা। তবে কারাগারে থাকায় অবৈধ আয় কিছুটা কমেছে। অভিযোগ আছে, টিনুর চাঁদাবাজির টাকার ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয় থানায়। তাই বছরের পর বছর টিনু ও তার সহযোগীরা নির্বিঘ্নে নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়।
গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর দুটি অস্ত্রসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন কথিত যুবলীগ নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী নূর মোস্তফা টিনু। এখনও কারাগারেই আছেন তিনি। সেখান থেকেই চকবাজার এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে— এমন তথ্যও মিলেছে। ইতিমধ্যে তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া সহযোগী জসিম উদ্দিন জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
গত বছর এক অভিযানে দুটি অস্ত্রসহ নূর মোস্তফা টিনুর গ্রেফতারের ঘটনায় র্যাব বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানার অস্ত্র আইনে মামলা (নং ২৪(৯)১৯) দায়ের করে। এ মামলায় টিনু বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। ২০০৩ সালেও প্রবর্তক এলাকা থেকে একটি অত্যাধুনিক একে-২২ অস্ত্রসহ (কোতোয়ালী থানার মামলা নং- ৪৪(৪)০৩) ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন টিনু। ২০১২ সালে পাঁচলাইশ থানায় বিস্ফোরক ও চাঁদাবাজি আইনে চাঁদাবাজি এবং হত্যাচেষ্টা আইনে চকবাজার থানায় দুটি মামলা দায়ের হয় টিনুর বিরুদ্ধে। এছাড়াও আরও একাধিক মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।
ফের স্বরূপে কিশোর অপরাধীরা
জানা গেছে, টিনুকে গ্রেপ্তারের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল তার সহযোগীরা। এরপর কিছুদিন তুলনামূলক নিরবেই ছিল সন্ত্রাসীদের দল। কিন্তু গত কয়েক মাসে চকবাজার, পাঁচলাইশ, বাকলিয়া এলাকায় কিশোর গ্যাংগুলো রীতিমতো ত্রাস ছড়াচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ অলিগলি ও মোড়গুলোতে গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে ফের আড্ডা জমাচ্ছে কিশোর অপরাধীরা। এসব কিশোর অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ইভান গ্রুপ। তাদের অন্যতম অর্থযোগানদাতা নবী নামের এক লোক। কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে নারী দিয়ে মিথ্যা মামলা করাই নবীর মূল অস্ত্র। তাই ভয়ে কেউ মুখ খোলে না।
জানা গেছে, চকবাজার এলাকায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে গত বছর যুবলীগ কর্মী লোকমান রনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টিনুর অনুসারী ও এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সাইফুল মারা যান। লোকমান হত্যাকাণ্ডের সময় ইভান ঘটনাস্থলে থাকলেও রহস্যজনক কারণে মামলায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গত বছরের শেষ দিকে চান্দগাঁও দর্জিপাড়া এলাকায় চাঁদা না পেয়ে জিয়াদ নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার কিশোর আরমান ও আজাদ টিনুর অনুসারী। বহদ্দারহাট হক মার্কেটের নৈশপ্রহরী আব্দুস সবুরকেও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিল কিশোর গ্যাং। ওই মামলার আসামি ইমন বড়ুয়া ও রিফাত টিনুর অনুসারী।
চকবাজারে কিশোর গ্যাংয়ের একটি অংশের নেতৃত্বে থাকা রবিউল ইসলাম রাজুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির ঘটনায় পাঁচলাইশ থানার মামলা (নং ৭৭৬/১৯) দায়ের হয়েছিল গত বছর। বর্তমানে এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। এছাড়া আধিপত্য বিস্তার ও ধারালো অস্ত্রে রক্তাক্ত জখম করায় চকবাজার থানার মামলা (নং ৭(৫)১৭) দায়ের হয়। শপিংমলে চাঁদা দাবি করায় চক সুপার মার্কেট পরিচালনা কমিটি চকবাজার থানার জিডি (নং ১৬০১(৯)১৯) দায়ের করে। এছাড়া গুলজার টাওয়ারে এক নারী দোকানিকে মারধর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুরের ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলা দায়ের হয়েছিল রাজু ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি যেখানে ভাই-ভাই
টিনুর কারাগারে যাবার পর অপরাধজগতের হাল ধরেছে তার ভাই নুরুল আলম শিপু। টিনু সরকারি দলের রাজনীতিতে যুক্ত, অন্যদিকে তার ভাই বিএনপি নেতা। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শিপুর নিয়ন্ত্রিত কিশোর গ্যাংয়ের হাতে দিনদুপুরে কাতালগঞ্জ এলাকায় খুন হয় স্কুল ছাত্র উৎপল বড়ুয়া। এটি ছিল ওই সময়ের চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
টিনুর ভাই নুরুল আলম শিপুর বিরুদ্ধে বোমা বিস্ফোরণ ও নাশকতার অভিযোগে পাঁচলাইশ থানায় মামলা (নং-২৬(১০)১৮ এবং ২(১০)১৮) দায়ের করেছিল পুলিশ।
তার আগে ২০১৭ সালে পাঁচ লাখ ছিনতাইয়ের ঘটনায় (মামলা নং-১৫(২)১৭) গ্রেফতার হন তিনি। টিনু গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে শিপুর একটি অডিও রেকর্ড ফেসবুকে ছড়িয়ে যায়। এর পরপরই চান্দগাঁও বারাই পাড়া থেকে এক ছাত্রলীগ নেতাকে তুলে নেতার চেষ্টা করেন তিনি। ভিকটিম সেদিন চান্দগাঁও থানায় একটি ডায়েরি (নং-৪১(১১)১৯) করে শিপুর বিরুদ্ধে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে।
পরবর্তী পর্বে
‘বড় ভাই’দের ছায়ায় চকবাজারের অলিগলিতে কিশোর গ্যাং
আরএ/সিপি