চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গার আকমল আলী রোড সংলগ্ন এলাকায় হামলায় এক যুবকের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও মামলা হয়নি। থানা পুলিশও এই ঘটনার কিছুই জানে না। এদিকে অসুস্থতায় ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে নিহতের বড় ভাই।
কিন্তু দুই নৌকার ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে এই হামলার ঘটনা ঘটে। একইসঙ্গে ওই যুবককে বেশি মারধরের কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, নিহত যুবকের নাম রনি (২৫)। তার বড় ভাই মামুনের নৌকার সঙ্গে গত ৩ ডিসেম্বর স্থানীয় ‘আক্কাস বাহিনী’র প্রধান আক্কাসের নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লাগলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর রনিকে বেধড়ক পেটানো হয়। আর এতেই তার কিডনি ও লিভার অকেজো হয়ে যায়। আহত অবস্থায় পাঁচদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎধীন থাকার পর রনির মৃত্যু হয়।
পুলিশ বলছে, পরিবারের কেউ থানায় এসে মামলা না করলে তাদের কিছুই করার নেই।
তবে মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘এমন হলে ভেঙে পড়বে আইনের শাসন। ঘটনা জানার পর পুলিশের উচিত নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা। প্রভাবশালীদের ভয়ে মামলা করতে রাজি না হলে তাদের অভয় দিয়ে মামলা করতে রাজি করাবে পুলিশ। আর যদি টাকায় ম্যানেজ হয়ে মামলা না করে তাহলে সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছে নিহতের পরিবার। আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে প্রশাসনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। না হলে আসামিরা আরও বেপরোয়া হয়ে অপরাধে উদ্বুদ্ধ হবে।’
অপরদিকে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার এমন পরিণতি দেখে বিব্রত স্থানীয়রা। তাদের দাবি, আক্কাস নামের এক প্রভাবশালী চোরাকারবারি জড়িত থাকায় ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে এই ঘটনা। রহস্যজনক কারণে পরিবার যেমন মামলা করেনি, তেমনি স্থানীয় পুলিশেরও কোনো আগ্রহ নেই এই ঘটনায়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে ‘আক্কাস বাহিনী’।
জানা গেছে, নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডে মাছের ব্যবসা করেন নিহত যুবক রনির বড় ভাই মামুন। এই ব্যবসায় বঙ্গোপসাগরের তার একটি নৌকাও রয়েছে। সেখানে চোরাকারবারি ‘আক্কাস বাহিনী’র একটি নৌকার সঙ্গে মামুনের নৌকার ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় গত ৩ ডিসেম্বর আকমল আলী রোড বেড়িবাঁধ গোল চত্বরে উভয়ের মধ্যে মারামারিও হয়। ঘটনার একপর্যায়ে মামুনের ছোট ভাই রনিকে একা পেয়ে ‘আক্কাস বাহিনী’র সদস্যরা মারধর করে। এরপর তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করা হলে গত ৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।
ঘটনার বিষয়ে জানতে নিহত রনির বড় ভাই মামুনের মুঠোফোনে টানা তিনদিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তিনি ফোন রিসিভ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে রনির মৃত্যু হয়েছে। ঘটনারদিন রনিকে সামান্য আঘাত করা হয়েছিল।’
মামলা না করা এবং মেডিকেল পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একটি বৈঠকে আছেন, আধা ঘণ্টা পরে ফোন দেবেন বলে কল কেটে দেন। পরে আর ফোন করেননি তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, এক সময়ের বিএনপি নেতা আক্কাস এখন সেখানকার আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা। টাকার জোরে আকমল আলী রোডে গড়ে তুলেছেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। তার কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে থানার ওসিকে ট্রান্সফারের হুমকি দেওয়ার ঘটনা এলাকায় ‘ওপেন সিক্রেট’। এলাকার সবার আক্কাস একজন চোরাকারবারি হিসেবে চেনেন।
মোংলা ও ভোলার চিহ্নিত কিছু জলদস্যুদের নিয়ে ইপিজেডের আকমল আলী রোড ও বেড়িবাঁধের বাস্তুহারা এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছেন একটি বাহিনী। সবার কাছে তা ‘আক্কাস বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত। এই বাহিনীই তার সকল অপকর্মের সঙ্গী। এলাকায় চোরাকারবারি, সাগরে জলসীমা (ফার) বিক্রি এবং নানা অপকর্মে এই বাহিনীকে কাজে লাগান তিনি। আকমল আলী রোড বেড়িবাঁধ প্রতিরাতে এই বাহিনীর দখলে থাকে। বিভিন্ন জাহাজ থেকে চাল, ডাল, চিনি ও মাদকসহ অবৈধ মালামাল চুরির অন্যতম পথ আকমল আলী রোডের বেড়িবাঁধ। এসব চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত ‘আক্কাস বাহিনী’।
নিহত যুবকের বন্ধু সাকিব বলেন, ‘কবির মাঝির নেতৃত্বে মোংলার প্রায় শতাধিক লোক আমাদের ওপর হামলা করে। এতে রনি গুরুতর জখম হয়। ওইদিন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি করানো হলে ৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কবির মাঝিসহ যারা হামলা করেছে, তারা সবাই আক্কাস বাহিনীর লোক। এর মধ্যে কেউ বলছেন আট লাখ টাকা, আবার কেউ বলছেন ১৬ লাখ টাকায় এই ঘটনা রফাদফা হয়েছে।’
৪০ ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল বারেক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আকমল আলী রোড বেড়িবাঁধকে চোরাকারবারিরা স্বর্গরাজ্য করে ফেলেছে। সেখানে অনেক খুন হয়েছে। আমার ভাগিনাকেও একবার আক্কাস বেঁধে রেখেছিল। আমি ফোন দিলে তাকে ছেড়ে দেয়। নিহত রনির পরিবার আমার রাজনৈতিক কর্মী। বিষয়টি একটু আপনারা দেখেন।’
এই বিষয়ে অভিযুক্ত আক্কাসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে নিহত রনি জেলেদের মারধরে আহত হয়েছেন বলে স্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, ‘যারা রনিকে মারধর করেছে তাদের কেউ আমার লোক নয়।’
কাউন্সিলর বারেক ফোন করে মামুনকে উদ্ধার করেছেন দাবি করে আক্কাস বলেন, ‘কমিশনার বারেক আমাকে ফোন করেছিল। আমি আমার পোলাপানদের ফোন করেছি। মামুনদের উদ্ধার করে আমার গদিতে (মাছের আড়ৎ) বসিয়ে রেখেছি। পরে তাদেরকে বারেকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ইপিজেড থানা পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল বশর জানান, এই ঘটনার কিছু তিনি জানেন না। প্রতিবেদকের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেকের মুঠোফেনে যোগাযোগ করেন।
পরে এ বিষয়ে মেডিকেলেও কোনো পুলিশ রেকর্ড নেই বলে জানান তিনি।
মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল বশর ফোন রিসিভ করেন। ওসি ছুটিতে আছেন জানিয়ে আবুল বশর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টি আপনাকে আগেও বলেছি, পরিবার আসলে আমরা মামলা নেব। এছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।’
একই কথা বলেন সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা। তিনি বলেন, ‘পরিবারকে পাঠান, আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তারা মামলা না করলে পুলিশের কিছুই করার নেই।’
এনইউএস/ডিজে