আকবরশাহের ওসি আকবর সুপ্রিমকোর্টের আদেশও মানছেন না, বারবার হামলায় অসহায় মুক্তিযোদ্ধার পরিবার
হামলার ঘটনায় মামলা না নিয়ে উল্টো জেলে পাঠানোর হুমকি
চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীর এক বীরমুক্তিযোদ্ধার পরিবারের ওপর বারবার ঘটছে হামলার ঘটনা। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকা সেই পরিবারকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য রয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনক কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উল্টো চিহ্নিত সন্ত্রাসীদেরই প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে নজিরবিহীন কৌশলে নগরীর তালিকাভুক্ত এক সন্ত্রাসীর নামই তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে পুলিশ।
সর্বশেষ ওই বীরমুক্তিযোদ্ধার পরিবারের এক সদস্যের ওপর নারকীয় কায়দায় হামলার ঘটনা ঘটলেও চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ থানার ওসি স্বয়ং এ নিয়ে মামলা নিতে চাননি। উল্টো মামলা দিলে কাউন্টার মামলায় জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন।
অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, নগরীর আকবরশাহ থানাধীন উত্তর কাট্টলীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের নির্মাণাধীন বাড়িতে ২৩ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ইটভর্তি একটি ট্রাক আনার পরপরই বাড়ির রাস্তার মুখে বাধা দেয় একদল লোক। এ সময় বাড়ির মালিক বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের ছেলে মোক্তার হোসেন বাধা দেওয়ার কারণ জানতে গেলে তার ওপর একযোগে চালানো হয় নারকীয় হামলা। এ সময় আকবরশাহ থানার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে সদ্য নাম বাদ যাওয়া চটপটি আলাউদ্দিনের স্ত্রী বিবি মরিয়ম ও ছেলে ফয়সাল ওরফে গুটি ফয়সাল ও ফরহাদ, তার বোন জামাই খোরশেদ আলমের পুত্র এমরান, ফোরকান ও দৌলত একযোগে মোক্তার হোসেনকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মেরে গুরুতরভাবে জখম করে। পরে মোক্তারের আর্তচিৎকারে পাশ্ববর্তী মহাসড়ক থেকে পথচারীরা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তের দল হুমকি দেয়, ভবিষ্যতে জায়গাটিতে কোন নির্মাণকাজ করা হলে বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের সদস্যদের একে একে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলবে।
ঘটনার পর মোক্তার হোসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মেডিকেল রিপোর্টে চিকিৎসকরা এলোপাতাড়ি হামলায় মোক্তারের মাথায় ‘হেড ইনজুরি’ শনাক্ত করেন।
এই ঘটনায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর মোক্তার হোসেনের বড় ভাই এডভোকেট এএইচএম জাহিদ হোসেন নগরীর আকবরশাহ থানায় মামলা করতে গেলে থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর মামলা না নিয়ে একটি জিডি (নম্বর ১৪৬১/২২) লিখিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবরের বিরুদ্ধে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে উল্টো হামলাকারীদের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকাশ্যে এমন হামলার ঘটনা ঘটলেও ওসি ওয়ালী আকবর শুরু থেকেই মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে অটল থাকেন। একপর্যায়ে তিনি হামলাকারীদের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়ার কথা বলে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। পরে ঘটনার সাতদিন পর মামলার জন্য অভিযোগ জমা দিতে বাদিকে বার্তা পাঠান।
হামলার শিকার মোক্তার হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা খুব অসহায়। বিচার ও পেলাম না। মামলাও নিল না। ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর উল্টো হুমকি দিয়েছেন মামলার রেকর্ডের চাপ দিলে বিপরীত পক্ষ থেকে কাউন্টার মামলা নিয়ে গ্রেফতার করে কোর্টে চালান করে দেবেন।’
জানা গেছে, নগরীর আকবরশাহ থানার উত্তর কাট্টলী ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের মালিকানাধীন একটি জায়গা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রাখেন আকবরশাহ থানার সন্ত্রাসী তালিকা থেকে সদ্য নাম কাটা যাওয়া আলাউদ্দিন ওরফে চটপটি আলাউদ্দিন। এ নিয়ে আইনি লড়াই শেষে গত বছরের ১ নভেম্বর সিভিল রিভিশন মূলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনকে বিনা বাধায় কাজ করার আদেশ দেন সংশ্লিষ্টদের। পরে প্রতিপক্ষ সুুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পক্ষে গত বছর দেওয়া ১ নভেম্বরের আদেশই বহাল থাকে।
অভিযোগে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনকে তার মালিকানাধীন জায়গায় নির্মাণকাজ করার জন্য উচ্চতর আদালত থেকে অনুমতি দেওয়া হলেও গত দুই বছর ধরে এই চক্রটি বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। অথচ পরিবারটি বাস্তবে কখনোই আইনি কোন সহায়তা পায়নি পুলিশের পক্ষ থেকে। গত বছরের নভেম্বরেও এই একই চক্র দা-বটি নিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের ওপর হামলা চালালেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন সহায়তা পায়নি অসহায় পরিবারটি।
অথচ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২৯৪৯/২১ নম্বর আদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর বীরমুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা চেয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ১১ মে সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) বরাবরে পাঠানো আকবরশাহ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এম সাকের আহমেদের দেওয়া প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে, মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক নির্মাণকাজে বাধা না সৃষ্টি করা সংক্রান্তে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বলবৎ রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়, ‘উক্ত বিরোধীয় সম্পত্তিতে বীর মুুক্তিযোদ্ধা জনাব জাকির হোসেন গং কর্তৃক নির্মাণ কাজে ইসহাক ও আলাউদ্দিন গং বাধা সৃষ্টি করা আইনগত অবৈধ বিধায় উক্ত রূপ বাধা প্রদান করিলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিধিমোতাবেক পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’
ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, এই চক্রটিকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় সাংসদ দিদারুল আলমও। মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের নির্মাণাধীন বাড়ি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও ভূমিদস্যু চক্রের জন্য তিনি লিখিত সুপারিশ করেছেন পুলিশ কমিশনারের কাছে।
অভিযোগের বিষয়ে আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি একপর্যায়ে ওসি তদন্তের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর আকবরশাহ থানার ওসি তদন্ত সাকের আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে আধঘন্টা পরে যোগাযোগ করবেন বলে জানান। তবে এরপর থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি।
সিপি