আওয়ামী আমলের মামলা নিয়ে বিএনপি নেতার বিস্ফোরক বক্তব্য, নেতাকর্মীরা হতবাক
প্রতিবাদে নির্যাতিতদের মানববন্ধন ও সমাবেশ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতারা নিজেরা অতি উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন মামলার আসামি হয়েছেন— এমন মন্তব্য করে দলের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্য মনোনীত আহ্বায়ক খাতুনগঞ্জভিত্তিক ব্যবসায়ী ইদ্রিচ মিয়া। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে হামলা ও মামলার শিকার হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও নেতিবাচক’ মন্তব্য করায় ৭২ ঘন্টার মধ্যে দলীয় পদ থেকে ইদ্রিচের অপসারণ চেয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। তারা ইদ্রিচ মিয়াকে ‘সুবিধাবাদী’ উল্লেখ করে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পুরোটা সময় দলটির দালালি করেছেন।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের পর থেকে আপনার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা আছে— এক সাংবাদিকের এমন এক প্রশ্নের উত্তরে ইদ্রিচ মিয়া বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটাও মামলা নেই। ২০১৫ সালের পরে আমার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা ছিল। আল্লাহর রহমতে তিনটা মামলা এর আগে (অন্তর্বর্তী সরকার আসার আগে) কমপ্লিট হয়ে গেছে। খালাস পেয়েছি। ২০১৮ সালের পরে আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতারা উদ্যোগী হয়ে মামলার আসামি হয়েছেন— এমন ইঙ্গিত করে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্য মনোনীত আহ্বায়ক ইদ্রিচ মিয়া বলেন, ‘যেহেতু ২০১৮ সালের পরে যারা দায়িত্বশীল ছিল, তারা অতি উৎসাহী হয়ে মামলায় জড়িত হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হয়েছে সেটা যাচাই-বাছাই করলে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে মামলার আসামি হয়েছে।’
ইদ্রিচ মিয়ার এমন বক্তব্য ছড়িয়ে পড়লে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলা ও হামলায় নির্যাতিত বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলীয় পদে থেকে এমন অপমানজনক বক্তব্যে হাজার হাজার নির্যাতিত নেতাকর্মীর মনে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত কয়েক হাজার বিএনপি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন, লক্ষ লক্ষ মামলার আসামি হয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা, বছরের পর বছর ধরে ঘরছাড়া ছিলেন তারা। দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে থেকে তিনি একজন বা দুজনকে বলেননি, পুরো দলকে মিন করে বলেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মী এমন আত্মঘাতী বক্তব্যে অপমানিত বোধ করছেন। তারা আমাদের কাছে এসে ক্ষোভ জানাচ্ছে।’
‘আওয়ামী দালালরা বিএনপিকেই অপমানিত করছে’
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ইদ্রিচ মিয়ার অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে ‘মামলা ও হামলায় নির্যাতিত পরিবারের’ দলটির নেতাকর্মীরা ব্যানারে এক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি মিছিল জামালখান এলাকা প্রদক্ষিণ করে।
মানববন্ধনে বিএনপির নির্যাতিত নেতারা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দুর্নীতি অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা জেল জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বিএনপিকে অন্তরে ধারণ করেছি বলে জেল-জুলুম খেটেছি । কিন্তু কয়েকদিন আগে যারা আহবায়ক কমিটিতে পদ পেয়েছেন, তারা দীর্ঘ ১৭ বছর আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন। সেই আওয়ামী লীগের দালালি করা লোকজন এখন পদপদবি নিয়ে বিএনপিকেই অপমানিত করছে।’
বক্তারা বলেন, ‘১৭টি বছর আমরা মামলা-হামলার শিকার হয়েও রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। সর্বশেষ ৫ আগস্ট আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিতাড়িত করেছি। রাজনৈতিক মামলায় আদালত প্রাঙ্গনে এখনও হাজিরা দিতে হয়। আর দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটিতে আসা ফ্যাসিবাদের দোসররা বলছে, আমরা নাকি নিজেদের দোষেই মামলা খেয়েছি। বিশেষ করে নতুন কমিটির আহবায়ক ইদ্রিস মিয়া সম্প্রতি নির্যাতিত নেতাকর্মীদের নিয়ে গণমাধ্যমে বিরুপ মন্তব্য করেছেন। আমরা তার এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সাথে তাকে এখনই দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি।’
কারা নির্যাতিত নেতারা আরও বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা রাজপথে ছিলাম। তাই আমরা মামলা হামলার শিকার হয়েছি। আর এখন যারা কমিটিতে এসেছেন তারা আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দালাল ছিলেন। যে কারণে হাসিনার সরকার তাদের কোনো ক্ষতি করেনি।’
মানববন্ধনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মামলা-হামলায় কারা নির্যাতিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গাজী আবু তাহের, মো. আবদুল মাবুদ, ইব্রাহিম সওদাগর, ইয়াসিন আরফাত, এসএম নয়ন, চৌধুরী হারুন, আলম খান, ওবায়দুল হক রিকু, মাকসুদুল হক রিপন, ফয়সাল সিকদার সোহান, মহিউদ্দিন সাগর, আব্দুল্লাহ আল নোমান, জিহাদ, এমরান, খোরশেদ, মিনহাজ উদ্দিন ইমন প্রমুখ।
কমিটি নিয়ে অসন্তোষ
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কমিটিতে পটিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ইদ্রিস মিয়াকে আহ্বায়ক এবং আনোয়ারা উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিন ওরফে লায়ন হেলালকে সদস্য সচিব করা হয়। জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাসকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করে কমিটিতে স্থান পাওয়া দুই যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম পাপ্পা এবং বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী।
ঘোষিত কমিটিতে দক্ষিণ জেলার আট উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পেয়েছেন তিন উপজেলার নেতারা। পাঁচটি পদের দুটিই আবার বাঁশখালীতে। এদের সকলেই আবার চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলমের ঘনিষ্ঠ এবং বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-সুবিধাও পেয়েছেন। বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকেই এ কারণে ঘোষিত কমিটিকে ‘এস আলমের পকেট কমিটি’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে চাঁদাবাজি, পদবাণিজ্য ও মামলাবাণিজ্যে জড়িত এক তরুণ কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, তার কালো থাবায় বিপুল টাকার লেনদেনে বিতর্কিত লোকরা দলের পদ পাচ্ছেন। এটা দলের জন্য চরম ক্ষতি বয়ে আনবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ জেলা বিএনপির শীর্ষসারির এক নেতা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইদ্রিচ মিয়ার অর্থ যোগানদাতা তার ভাইপো সাইফুল ইসলাম সুমন। সেই সুমন কিন্তু সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার গনঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘ দিন আত্মগোপনে থেকে গত ৫ জানুয়ারি রাতে একই বিমানে ওমরা পালনের নামে সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে। ইদ্রিচ মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়কের পদ পাইয়ে দিতে সুমনের জোর লবিং ও টাকার বিনিময় ছিল বলে কেন্দ্রীয় নেতারাও আমাদের বলেছেন।’
পদের বিনিময়ে ‘দেড় কোটি’!
সুমনের ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসচারেক আগে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রামে বিএনপির এক তরুণ কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। অবিশ্বাস্য অংকের টাকার বিনিময়ে সুমনকে ‘প্রটেকশন’ দিতে সম্মত হন ওই বিএনপি নেতা। জানা গেছে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সুমনের বিদেশ পালানোর সবরকম ব্যবস্থা করেছিলেন ওই নেতাই, যিনি নিজেও এর দুই দিন আগে বিদেশে যান। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা সাইফুল সুমন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সহ–সভাপতি ইদ্রিস মিয়ার ভাইয়ের ছেলে। ইদ্রিস মিয়াকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতির পদ পাইয়ে দিতে বিএনপির ওই নেতাকে সুমন দেড় কোটি টাকা দেন বলে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে।
ইদ্রিস মিয়া সম্পর্কে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে তাকে কখনোই আন্দোলন-সংগ্রামে যায়নি। ছিলেন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। তবে সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল আলমসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। ৫ আগস্টের পর বহু আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসার রক্ষকও হয়ে উঠেছেন তিনি। বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদ্যঘোষিত আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ইদ্রিস মিয়ার ‘রাজপথের যোগ্যতা’ জানতে চেয়ে ফয়সাল মাহমুদ নামে এক বিএনপি কর্মী লিখেছেন, ‘ইদ্রিস মিয়ার বিএনপিতে রাজপথে কি যোগ্যতা ছিল শেষ পাঁচ বছরে, কারও জানা থাকলে বলবেন।’
সিপি