অবিশ্বাস্য স্টোকসে ইংল্যান্ডের অকল্পনীয় জয়
অ্যাশেজ সিরিজে সমতায় ফিরলো ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের আবহাওয়া কোন পূর্বাভাস ছাড়াই রূপ বদলায়। এই বৃষ্টিতো এই ঝলমলে রোদ। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটও অনেকটা তাদের আবহাওয়ার মতো। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের ভাষায় ‘ইংল্যান্ড যাকে ইচ্ছা তাকে হারায় আবার যার কাছে ইচ্ছা তার কাছেই হারে!’ কিন্তু তাই বলে এতোটা কে ভেবেছিলেন? ইংল্যান্ডের পার ভক্ত-সমর্থকরাও ভাবেননি ম্যাচে ইংল্যান্ডের কোন আশা আছে। আগের ইনিংসে ৬৭ রানে অলআউট হওয়া ইংল্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে তাড়া করবে ৩৫৯ রান! চতুর্থ দিনে দ্বিতীয় সেশনে এসে ইংল্যান্ড ২৮৬ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে তখন অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের আরেকটি হার দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। জয় তখনো ৭৩ রান দূরে। কিন্তু সবাই যখন জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছেন একজন বেন স্টোকস যিনি কখনো জয়ের আশা ছাড়েন না তিনি অবিচল দাঁড়িয়ে গেলেন। তার অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংসে ভর করে হেডিংলি টেস্টে ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয় পেয়েছে ইংল্যান্ড। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে এ প্রথমবারের মতো চতুর্থ ইনিংসে সাড়ে তিনশ রানের বেশি তাড়া করে জিতল তারা। অ্যাশেজ ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বার এবং টেস্ট ইতিহাসে এগারতমবারের মতো সাড়ে তিনশ রানের বেশি তাড়া করে জেতার নজির দেখল ক্রিকেট বিশ্ব।
অস্বীকার করার উপায় নেই, ভাগ্যের সহযোগিতা স্টোকস পেয়েছেন। ৩৩ রানে নাথান লায়নের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নারের হাতের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছে সে বল। সেই লায়নের বলেই জোরালো এলবিডব্লুর হাত থেকে বেঁচে গেছেন স্টোকস। অস্ট্রেলিয়া রিভিউ নিতে পারেনি। কারণ আগের ওভারেই নিশ্চিত লেগ স্টাম্পে পিচ করা বলেও রিভিউ নিয়েছিল উইকেটের জন্য মরিয়া অস্ট্রেলিয়া। ফলাফল, ১ রানের অবিশ্বাস্য এক জয় হাতছাড়া অস্ট্রেলিয়ার। তার আগের বলেই নিশ্চিত রান আউট নষ্ট করেছেন ওই লায়ন। স্টোকসের সঙ্গে অন্য প্রান্তে আঠা হয়ে লেগে থাকা লিচ দৌড় দিয়ে অর্ধেক পিচ পার হয়েও ফিরে আসতে পেরেছেন লায়ন সহজতম এক থ্রো ধরে স্টাম্পে না লাগাতে পারায়। তখনো জয় থেকে ২ রান দূরে ছিল ইংল্যান্ড। প্যাট কামিন্সের করা পরের ওভারের তৃতীয় বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্কোর সমান করেন লিচ। আর চতুর্থ বলে এক্সট্রা কভার দিয়ে বাউন্ডারি মেরে বীরত্বপূর্ণ ইনিংসের মধুর সমাপ্তি টানের বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস।
২৮৬ রানে নবম উইকেট হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। জয় তখনো ৭৩ রান দূরে। জ্যাক লিচের টেস্টে ৯২ রানের ইনিংস আছে সে তথ্য কোনো সাহস দিচ্ছিল না। প্রতি বল খেলার আগে রুমাল বের করে লিচের চশমা মোছার দৃশ্যও কোনো সমর্থকের জন্য স্বস্তিদায়ক বিষয় নয়। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ কিংবা কোনো ক্রিকেট ম্যাচ জেতার জন্য দুই প্রান্তেই রান তোলার দরকার এটা কে বলেছে? ৬২ বলের জুটিতে ১৭ বল খেলা লিচ প্রথম রান করলেন ১৭তম বলেই। আর ওই রানেই দুই দলের রানের সমতা চলে এল। জুটির আগের ৭২ রানের বাকি ৭১ রান তোলার দায়িত্বটা যে নিজের কাঁধেই বুঝে নিয়েছেন স্টোকস।
বিশ্বকাপ ফাইনালে দলকে যেভাবে জিতিয়েছেন তারপর ক্যারিয়ারের বাকি সময়ে উল্লেখযোগ্য কিছু না করলেও চলত বেন স্টোকসের। একাই টেনে নিয়ে সেদিন ম্যাচ টাই করেছিলেন স্টোকস। টেল এন্ডার নিয়ে কীভাবে খেলতে হয় সেটা সেদিনই দেখিয়েছেন। এর চেয়ে ভালো খেলা সম্ভব নয় বলেই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু স্টোকসই দেখালেন জেতার প্রতিজ্ঞা থাকলে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
গতকালই জানা গিয়েছিল ইতিহাস করতে হবে ইংল্যান্ডকে। ৩৫৯ রানের লক্ষ্য যে কখনোই এর আগে তাড়া করতে পারেনি তারা। জো রুটের সুবাদে তবু আশা দেখছিল ইংল্যান্ড। ৭৫ রানে থাকা রুটের কারণে আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন স্টোকস। তাঁর নামের পাশে যে ছিল মাত্র ২। কিন্তু সেই ২ রান ৫০ বল থেকে করেছেন, এটাই বলে দিয়েছিল দরকার হলে শেষ দুই দিন ব্যাট করে হলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান স্টোকস। আজ দিনের শুরুতেও প্রথম ১৬ বলে কোনো রান। ৬৭তম বলে তাঁর নামের পাশে ৩ লেখা গেল। পরের বলেই রুট আউট!
তবু নিজের ব্যাটিং স্টাইল বদলায়নি। বেয়ারস্টোকে রান তোলার দায়িত্ব দিয়ে নিজের মতোই এগোচ্ছিলেন। বেয়ারস্টোকে পাশে নিয়ে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু লায়নের বলে নিজে জীবন ফিরে পাওয়ার পরের বলেই বেয়ারস্টোকে আউট হয়ে যেতে দেখলেন। জয় তখনো ১০৪ রান দূরে। জস বাটলার এলেন আর গেলেন। ওকসও টিকলেন না বেশিক্ষণ। স্টুয়ার্ট ব্রড যখন ফিরলেন, স্টোকসের রান তখন ৬১।
প্রথম চার মেরেছেন ৭৪তম বলে। ৮০ বল খেলার পরও তাঁর নামের পাশে ছিল ৭! নবম উইকেট পড়ার ১৭৪ বলে ৬১ রানের সংগ্রামী ইনিংসটা মাঠে মারা যাবে বলেই মনে হচ্ছিল। সেই স্টোকস সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ১৯৯তম বলে। জশ হ্যাজলউডকে মিড উইকেট দিয়ে মারা চারে সেঞ্চুরি পেরিয়ে পরের দুই বলে আবার দুই ছক্কা। এর আগেই নাথান লায়নকে তিন ছক্কা মেরেছেন, দুটি একই ওভারে। ভয়ংকর মনে হওয়া কামিন্সকেও। সেঞ্চুরির পর কামিন্সের টানা দুই বলে আবার ছক্কা মেরেছেন। শেষ জুটির ৭৬ রানের ৭৪ রানই (৪৫ বলে) এনে দিয়েছেন স্টোকস। এর ৫৮-ই (৭ ছক্কা ও ৪ চার) এসেছে বাউন্ডারি থেকে।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ টেল এন্ড নিয়ে কীভাবে ব্যাট করতে হয় সেটার সেরা উদাহরণ সৃষ্টি করে দিলেন স্টোকস। প্রতি ওভারের প্রথম চার বলে বাউন্ডারি বা ২ করে রান তুলে পঞ্চম বলে সিঙ্গেল নিয়েছেন, শেষ বল খেলার আস্থা রেখেছেন সঙ্গীর ওপর। পুরো মাঠে ছড়িয়ে থাকা ফিল্ডারদের মাঝেও জায়গা খুঁজে বাউন্ডারি বের করে নিয়েছেন। নিজে আক্রমণাত্মক হয়েছেন, ফলে জয়ের গন্ধ পেয়েও আক্রমণাত্মক হতে পারেনি অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা। এভাবেই অবিশ্বাস্য এক গল্প উপহার দিয়েছে টেস্ট ক্রিকেটকে। ম্যাচ শেষে নিজেও বর্ণা করতে পারেননি কী হচ্ছিল উইকেটে, ‘আমি জানি না। শুধু হাল ছাড়েনি, শেষ হওয়ার আগে শেষ বলিনি। লিচ আশার পর কী করতে হবে জানা ছিল পাঁচ বল ও এক বল।’
ম্যাচ জিতিয়েও তাই কীভাবে উদ্যাপন করতে হবে বলতে পারলেন না, ‘শুধু চেষ্টা করছি যা হলো তা উপভোগ করার। কারণ, আমি জানি না এমন কিছু আর কখনো হবে কি না।’ বাস্তবতা বলছে, হবে না। কিন্তু স্টোকসের এমন এক ইনিংসের দিনে কী সম্ভব আর কী অসম্ভব সে আলোচনায় যাওয়াটাই তো বোকামি!