অবহেলায় মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু করোনা ফিল্ড হাসপাতালে
বিপদাপন্ন রোগীকে রাত তিনটায় বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়
চট্টগ্রামের করোনা ফিল্ড হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় অক্সিজেন না পেয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু ঘটেছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।
চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার বাসিন্দা রফিকুল আলম বুধবার (২০ মে) দিবাগত রাতে মারা যান। তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কোতোয়ালী থানা শাখার ডেপুটি কমান্ডার রফিকুল আলম ১৫ মে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন। রোববার (১৭ মে) ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো হলেও ১৯ মে দিবাগত রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হঠাৎ তাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলে তার স্বজনদের। এরপর ওই মুক্তিযোদ্ধাকে কাজীর দেউড়ির নিজ বাসায় আনার কয়েক ঘন্টা পরই তিনি মারা যান।
অবহেলায় মুক্তিযোদ্ধায় এমন বেদনাবিধূর মৃত্যুর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সরওয়ার মনি ফেসবুকে লিখেছেন— ‘পরশু দিন চাচাকে ফিল্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওনার কভিড-১৯ পজিটিভ ছিল। রিমা (মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলমের মেয়ে) আমাদেরকে জানালে আমি এবং মনি ভাই বিষয়টি নিয়ে ফিল্ড হাসপাতালের সাথে কথা বলি। তারা চাচার অবস্থা ভাল বলে জানায়।
গতকাল রাতে ১.৪৫ এর দিকে রিমাকে ফোন করে জানাই যে বিদ্যুৎ বড়ুয়া চাচাকে হাসপাতালে রাখতে চাচ্ছে না। ওরা যেন চাচাকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি খবরটা শুনে বিদ্যুত বড়ুয়াকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বড়ুয়া রিমাকে কয়েকবার ফোন দিয়ে চাচাকে নিয়ে আসতে বলেছে।
এত রাতে কিভাবে চাচাকে বাসায় আনবে তার মধ্যে করোনা পজিটিভ— এই সবকিছু মিলে চাচার পরিবারের সদস্যরা কোন কুলকিনারা না পেয়ে আবার আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। সর্বশেষ ২.৩০ দিকে রিমাকে আমরা বলেছি যে সকাল পর্যন্ত সময় দিতে যেন বিদ্যুত বড়ুয়াকে অনুরোধ করে। সকালে জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু বিদ্যুৎ বড়ুয়া চাচাকে রাত তিনটার দিকে বাসায় নিয়ে আসে। আর ভোর ৫.৩০ এর দিকে চাচা নিজ বাসায় মারা যান। অক্সিজেন সাপোর্ট থাকলে হয়তো চাচা বেঁচে থাকতেন। এই কান্ডজ্ঞানহীন কাজটি কিভাবে ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যুৎ বড়ুয়া করতে পারলো? চাচাও চলে গেলেন পরিবারের সদস্যদের ও বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।’
যে হাসপাতাল নিয়ে চট্টগ্রাম মানুষের কিছুটা আশাবাদী ছিল সে হাসপাতালে এমন কান্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের অভিভাবক বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক চাচাকে হারাতে হয়েছে। এসব হাসপাতাল কি পাবলিসিটি করার জন্য?’
চান্দঁগাও থানা যুবলীগ নেতা কায়সার হামিদ প্রশ্ন তুলেছেন— ‘একজন করোনা ভাইরাস পজিটিভ রোগীকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা? ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্তত সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন না? রাত ৩ টায় কেন বাসায় পাঠাতে হবে? ফিল্ড হাসপাতালে থেকে যদি রোগী স্বেচ্ছায়, রোগীর স্বজনের ইচ্ছায়ও রোগী চলে আসতে চায়, তাহলে করোনা ভাইরাস পজিটিভ রোগী বাসায় চলে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া সঠিক ছিল কিনা? ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি অন্য কোনো করোনার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে পারতেন না?
তিনি লিখেছেন, ‘চাচাকে হারালাম সাথে পুরো পরিবারটাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। বাসায় না পাঠিয়ে অন্য কোন হাসপাতালে নিলে হয়তো চাচা আমাদের মাঝে থাকতেন।’
এই বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল আলমের মেয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কোতোয়ালী থানা কমিটির সদস্য সচিব শাহনাজ রিমা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমার আব্বুর অস্থির লাগছিলো সেজন্য কান্নাকাটি করছিলেন। অন্য রোগীদের সমস্যা হচ্ছে সেজন্য ফিল্ড হাসপাতাল থেকে বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন আব্বুকে নিয়ে যেতে। এত রাতে কোথায় নিয়ে যাব— সকাল পর্যন্ত রাখার জন্য অনুরোধ করা হলেও তারা অনুরোধ রাখেননি। করোনা পজিটিভ অক্সিজেন না পেলে আব্বু কিভাবে থাকবে— এটা বলার পরও তারা আব্বুকে ডিসচার্জ দিয়ে দেন। বাসায় আনার কয়েক ঘন্টা পর আব্বু মারা যান।’
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে ফিল্ড হাসপাতালের কর্মকর্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি ১৭ মে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন ওনার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আস্তে আস্তে একটু উন্নতি হয়। তাছাড়া উনাকে অক্সিজেন দিলে অক্সিজেন খুলে সারাক্ষণ হাঁটাহাটি করতেন। সেদিনও অক্সিজেন খুলে হাঁটাহাটি করছিল। ওখানে একজন রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল এবং অন্যান্য রোগীদের ওনার এমন অদ্ভুত ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছিল। ওনাকে এমন করছেন কেন জিজ্ঞেস করলেই সবাইকে বকাঝকা করতেন। প্রত্যেক রোগীর সিটের সামনে মাস্ক ছাড়া গিয়ে তাদের ডিস্টার্ব করতেন। সব রোগীর অভিযোগ ছিল করোনা পজিটিভ রোগী মাস্ক ছাড়া সবার সিটে এসে বকাঝকা করা নিয়ে। ওনাকে কোনমতে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না।
বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, ‘সে মুহূর্তে ওনার ছেলেকে কল দিই। সন্তান হিসেবে যদি বাবাকে এসে বোঝাতো। সেটা না করে তারা বললো ওনাকে বাসায় পাঠাতে। তখন আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। সন্তান হিসেবে কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে। মেডিকেলে একবার দেখতেও আসেনি তারা। তাদের সাহায্য সহযোগিতা পেলে উনি আরো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতো। বাসায় নিচে ওনাকে নিয়ে যাওয়া হলে ছেলে নিচে নামেনি। তখন শুধু মেয়ে ছিল উনার পাশে।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বির বক্তব্য আবার আরেকরকম। তিনি বলেছেন, ‘করোনা পজিটিভ কমান্ডার রফিকুল আলম চিকিৎসাধীন ছিলেন ফিল্ড হাসপাতালে। মঙ্গলবার রাতে স্বজনরা তাকে বাসায় নিয়ে যান। সকালে জেনারেল হাসপাতালে আনার কথা ছিল। কিন্তু হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা যান।’
আরএ/সিপি