কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উন্নয়নের প্রায় এক কোটি টাকা ফেরত চলে গেল। জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ সঠিক সময়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারায় এ টাকা ফেরত গেল। ফলে চলতি বছর চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে দারুণভাবে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন চকরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলার অন্তত ২০ লাখ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উন্নয়নে প্রথম দরপত্র আহবান করা হয়। এরপর ২০২০ সালের মে মাসের ১১ তারিখ ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দেন। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও স্থানীয় মিলে অন্তত ১০ জন ঠিকাদার অংশ নেন। কিন্তু সর্বনিম্ন দরদাতা না পাওয়া এবং কাগজপত্র সঠিক না থাকার অজুহাতে ওই টেন্ডার বাতিল করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে ২০২০ সালের ২৯ মে আবারও দ্বিতীয়বারের মতো দরপত্র আহবান করা হয়। চলতি বছরের ১৪ জুন আবারও দরপত্র জমা দেন ঠিকাদাররা। ওই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় চারটি ঠিকাদারি কোম্পানি অংশ নেয়। কিন্তু ওই টেন্ডারও নানা অজুহাতে বাতিল করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য হাসপাতালে জরুরিভিত্তিতে ছয়টি গ্রুপে ছয়টি সরঞ্জামের ওপর ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৩০ টাকার টেন্ডার আহবান করা হয়। এর মধ্যে অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) বহির্ভুত ওষুধের জন্য ৩১ লাখ ২৬ হাজার ২৪৬ টাকা, যন্ত্রপাতি বাবদ ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪১০ টাকা, গজ-ব্যান্ডেজ বাবদ ৮ লাখ ৯৩ হাজার ২০৫ টাকা, লিলেন বাবদ ৮ লাখ ৯৩ হাজার ২০৫ টাকা, কেমিক্যাল বাবদ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৮২ টাকা, মেরামত বাবদ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৮২ টাকা এবং আসবাবপত্র বাবদ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৮২ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
অপরদিকে হাসপাতালের জন্য ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকার ওষুধের চাহিদা পাঠানো হয়। তার বিপরীতে ৭০ লাখ টাকার ওষুধ দেওয়া হয়। বাকি ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকার ওষুধ সংগ্রহ করতে না পারায় সেই টাকাও ফেরত চলে যায়।
জানা গেছে, অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) হল সরকারি প্রতিষ্ঠান। মোট বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ তারা সরবরাহ করে থাকে। বাকি ২৫ শতাংশ কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদাররা সরবরাহ করেন।
সূত্র জানায়, ইডিসিএল বর্হিভুত ওষুধসহ ছয়টি গ্রুপের সরঞ্জাম বাবদ ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৩০ টাকাসহ সরকারি ওষুধ বরাদ্দে ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকাও ফেরত গেছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা ফেরত চলে যায়।
টেন্ডার প্রক্রিয়ার অংশ নেওয়া মেসার্স শাহিন ফার্মেসীর প্রতিনিধি আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা সব ধরনের নিয়ম মেনে টেন্ডারে অংশ নিলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে দেয়।’
এরকম আরও বেশ কয়েকজন ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, দুই দুইবার সব ধরনের প্রক্রিয়া মেনে টেন্ডারে অংশ নিলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে টেন্ডার প্রক্রিয়াটি বাতিল করা হয়েছে। যার কারণে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত প্রায় ১ কোটি টাকা ফেরত গেছে। এর ফলে চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে দারুণ সংকটে পড়বে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তারা আরও বলেন, মূলত যেসব শর্ত দিয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে তা কোন ঠিকাদারের পক্ষে কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব ছিল না। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুটা শিথিলতা দেখালে হয়তো এই টাকাটা ফেরত যেত না।
জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নেয়। তার মধ্যে জরুরি সেবা অর্থাৎ হাত-পা ভাঙ্গা, দুর্ঘটনা ও মারামারিতে আহত রোগী বেশি। এসব রোগীদের জরুরি সেবার জন্য দরকার হয় গজ-ব্যান্ডেজসহ নানা সরঞ্জাম। কিন্তু ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এসব সরঞ্জাম কেনার টাকা ফেরত যাওয়ায় কষ্টে পড়বে জরুরি বিভাগের এসব রোগীরা। আগে যেখানে এসব সরঞ্জাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে দিতো, এখন তা রোগীদের বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে।
এই হাসপাতালে চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা মহেশখালী, পেকুয়া-কুতুবদিয়া, লামা ও আলীকদমের জরুরি রোগীরা আসেন প্রতিদিনই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এতো বিশাল অংকের টাকাটা ফেরত গেল। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে যা ঠিকাদারদের পূরণ করা খুব কঠিন ছিল। এসব শর্তে কয়েকটাও যদি শিথিল করা হতো তাহলে অন্তত একজন ঠিকাদার হলেও কাজটা পেতে পারতো। মূলত হাসপাতালের একজন স্টাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে (টিএইচও) ভুল বুঝিয়ে টেন্ডারটি শেষ করতে দেননি। যার মাশুল চকরিয়াবাসীকে দিতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহবাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাংসদ ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জাফর আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি আসলে সভাপতি হলেও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমার কোনো হাত নেই। এটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এতো বড় অংকের টাকা ফেরত যাওয়ায় চকরিয়াবাসীর জন্য চরম ক্ষতি হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে সিভিল সার্জন ও টিএইচওকে বলেছি যাতে প্রকল্পের টাকা ফেরত না যায়। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছিল টাকা ফেরত যাবে না। পরে শুনলাম প্রকল্পের টাকা ফেরত গেছে।’
এএইচ/সিপি